Dataset Viewer
Auto-converted to Parquet
image
imagewidth (px)
594
2.1k
text
stringlengths
1
3.36k
আমার হাতে এই মুহূর্তে যে কাগজটি আছে খাঁটি বাংলায় তার নাম তালাকপত্র । বুয়ার ভাষায় ডাইফুস লেটার । আপনি যহন ব্যাডরুমে ঘুমে ছিলেন, তখন একটা লুক আইস্যা এই প্যাপারডা দিয়া গ্যালো । ময়মনিসংহের মানুষ বাংলা সাহিত্যের বিশাল একটা অংশজুড়ে দখলদারিত্ব রাখলেও উচ্চারণে বেদখল নিজের মতো। ও-কারকে হ্রস্য উকার আর এ-কারকে য-ফালা বলতে সামান্য দ্বিধাবোধ করে না তারা । নতুন নিয়োগ দেয়া আমাদের এই ঠিকা বুয়ার বাড়িও ঢাকায় অবস্থানকারী শতকরা আশিভাগ বুয়ার ময়মনসিংহ । নিয়োগের কারণ নবীনার সদ্য শুরু হওয়া চাকরির ব্যস্ততা এবং ঘনঘন ঢাকায় না থাকা । যথারীতি বাসার কাজের প্যাচ কম বুঝলেও, অন্য বুয়াদের মতো সে অতি দ্রুত বুঝে ফেলেছে সংসারের গোপন প্যাঁচ । খামটা তোলামাত্রই প্রশ্ন করলো, ভাইয়া, কাগুজডা কী আপায় দিচ্ছে? বুঝলে কী করে ? হ্যাঁ, খামের উপরে কুড়িগ্রাম ল্যাহা আছিলো । নর্থবেঙ্গল কাজের লোকদের মতো ময়মনসিংহের বুয়ারা মূর্খ হয় না । সামান্য হলেও লেখাপড়া জানে । সকাল সকাল পত্রিকায় হেডলাইন দেখে অনায়াসে বলে দিতে পারে, হরতাল করে আছে । ভাইয়া, খারাফ কুনো খবর? সেরকমই তো মনে হয় । আমি কাগজ খুললাম। সরকারি স্ট্যাম্পের মতো নীল কাগজে ছাপা কিছু দাপ্তরিক বক্তব্য । এইডা কী ভাইয়া কুটের প্যাপার? কথা ঘুরালে আগ্রহ বাড়বে । এই শ্রেণির লোকদের এটাই স্বভাব । সুতরাং অতি দ্রুত উত্তর দিলাম । মনে হয় তালাকনামা । ১৬১
অবাকের শ্রেণিবিচ্ছেদে আমি সপ্তম আসমানে থাকলেও, বুয়া অষ্টম আসমান থেকে পল্টি খেয়ে পড়লো । ওরে আমার আফারে । আপনি শ্যাষম্যাষ.... কথার মাঝখানে বিরক্ত হয়ে আমি চূড়ান্তভাবে বুয়াকে থামালাম । তুমি এখন সামনে থেকে যেতে পারো । বিষয়টা আসলেই সুস্পষ্ট নয় আমার কাছে । আমি ভালোভাবে উল্টেপাল্টে কাগজটা দেখলাম । না কোনো ভুল নেই কোথাও । এমনকি স্বাক্ষর তারিখও নবীনার হাতের লেখা । কারণটা কী? গত সাত আটদিনে এমন কোন ভয়াবহ সমস্যা হয়নি, যা থেকে এই কাগজটা আমার পাওনা হতে পারে। প্রেমিক প্রেমিকেরা পার্কে ঘুরে ঘুরে, রাস্তায় হাত ধরে ধরে, এমনকি রিক্সায় হুড উঠিয়ে চলতে চলতে একসময় একঘেয়ে হয়ে গেল, একজন আরেকজনকে এসএমএস পাঠায় । Sorry, I had a very good time with you. কিন্তু নবীনার কাছ থেকে পাওয়া এটা কী! আমি খামটা আরেকবার দেখলাম । ভেতরে আরও একটা কাগজ আছে বলে মনে হচ্ছে । হ্যাঁ, নবীনার লেখা । আমাকে উদ্দেশ্য করে লেখা নবীনার বক্তব্য। তবে ঠিক চিঠি বলা সমীচিন হবে কিনা, বুঝতে পারছি না। সম্মোধন, প্রেরক, প্রাপক কারও নাম নেই। নেই চিঠি লেখার সাধারণ ফরমেট । কুশলাদি বিনিময়, আমন্ত্রণ, এমনকি উপসংহার পর্যন্ত বাদ দিয়ে লেখা একটি দীর্ঘ লিখিত বক্তব্য । বাংলা ব্যাকরণবিদরা এসএমএস থেকে শুরু করে চিঠি পর্যন্ত মানুষের ভাবের আদান-প্রদানের এই ভগ্নদশা দেখলে হয়তো সত্যিই মনঃকষ্ট পেতেন আজ । নবীনার চিঠি । তোমার ব্যস্ততম জীবনে এক ধরনের যন্ত্রণা বলেই মনে করতে পারো এই বিষয়টিকে । তবে যে তীব্র যন্ত্রণা আমি মনে মনে পুষে বেড়াচ্ছি দীর্ঘদিন ধরে, আজ তার অবসান করতে চাই । ১৬২
মানুষের জীবনে ভালোলাগা, ভালোবাসা কিংবা ভালোথাকা বিষয়গুলো সবসময় একরকম থাকে না । একটা সময় আমার প্রতি তোমার তীব্র ভালোলাগায় যে ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল তা দীর্ঘস্থায়ী ভালো থাকেনি । হয়তো আমার দেবার সীমাবদ্ধতা কিংবা বুঝবার স্বল্পতায় তুমি দিন দিন আমার বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে নিজেকে জড়িয়ে তুলছো অন্য ব্যস্ততায় । এদিকে আমার নিজেরও যে আলাদা একটা জগৎ আছে, আলাদা একটা জীবন আছে, আলাদা একটা ভালোবাসা আছে, সে বিষয়টা তোমার কাছে উহ্য থেকেছে সর্বসময় । হঠাৎ করে শিবলী অসুস্থ না হয়ে পড়লে, হয়তো কখনো জানা-ই হতো না নিজেকে নিজের মতো করে সেসব বিষয়ে । আমেরিকায় চলে যাবার আগপর্যন্ত শিবলীর পাগলামি আর হেয়ালিপনায় নিজের মধ্যে কেন যেন অজানা একটা বিশ্বাস তৈরি হয়ে ওঠে আরেকবার । তখনও ভেবেছিলাম এসব মিথ্যে, হয়তো ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এ দেশ থেকে প্রায় দশহাজার মাইল দূরে থেকেও শিবলীর প্রতিদিনের রোজনামচায় আমার নিজেকে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি প্রতিদিন । ফেসবুকে নিত্যদিনের যোগাযোগ কিংবা ই-মেইল করে মনের ভাব প্রকাশ হয়তো এক ধরনের দুর্বলতা হতে পারে আমার কিংবা হতে পারে তোমার ব্যস্ততার সুযোগ বুঝে ব্যবহার। দোষ দিতে পারো কিংবা সুযোগ সন্ধানী শব্দটিও ব্যবহার করতে পারো আমার জন্য । তবে এটাও সঠিক যে, আমি অদৃশ্য শক্তির কাছে পরাজিত । মোমের মতো আমার যে নিভু নিভু আলো, তা আজ উপেক্ষিত তোমার কাছে । কিন্তু সেই আলো যদি অন্য কারো আলোকবর্তিকা হিসেবে বিবেচ্য হয়, তাহলে আমার কি করা উচিত। হয়তো মহামানবের মতো উৎসর্গ শব্দটি আমার জন্যও প্রযোজ্য হতে পারে । কিন্তু আজ বহুদিন পর বিবেকের সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে আর মিথ্যে কথা বলে অপমান করতে ইচ্ছে করছে না । বরঞ্চ সেটাই ভালো, অভিনয় না করে সরাসরি বলে দেয়া আমি আর তোমার থাকতে পারছি না । আমার সত্তায় যে দাঁড়িয়ে আছে, আমি যার চেতনায় দাঁড়িয়ে থাকি সর্বক্ষণ, তার দিকে পথ বাড়ানোই সঠিক । এর সাথে দেয়া কাগজে স্বাক্ষর করে দিলে আমি ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়াবো এবং তোমাকেও মুক্ত করবো অযাচিত আমার দ্বারা তৈরি শৃঙ্খল থেকে । ভালো থেকো তোমার মতো । ১৬৩
আমি এক থেকে শুরু করে পরপর তিনবার চিঠিটা পড়লাম । না, কোথাও ভুল নেই । ভুল শুধু এটুকু যে নবীনা ভেবে নিয়েছে আমার ব্যস্ততায় সে নেই । কিংবা তার নিঃসঙ্গতায় আমার জড়ানোটুকু অর্থহীন । বাদবাকি সব অভিযোগ নির্বাকভাবে মেনে নেবার মতো । এই ডিজিটাল যুগে চিন্তাকে দীর্ঘায়িত না করে সরাসরি মোবাইলের আশ্রয় নিলাম । দ্য নাম্বার ইউ কল ক্যান'ট বি রিচড় এট দ্য মোমেন্ট । প্লিজ ট্রাই এগেইন লেইটার । আপনি যে নাম্বারে ফোন করেছেন, তা এই মুহূর্তে.... কী ব্যাপার, এতবড় সিদ্ধান্ত অথচ এত দ্রুত! আমি কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করলাম বিভিন্ন মাধ্যমে । জানতে পারলাম নবীনা কথা বলতে নারাজ । সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । স্বামীরা স্ত্রীকে ছেড়ে দিতে চাইলে, স্ত্রীর পরিবার থেকে বারংবার যোগাযোগ অত্যন্ত সাধারণ আমাদের সংস্কৃতিতে । কিন্তু বিষয়টা যখন উল্টো হয় তখন? না, আমার পরিবারের দু একজন বয়োজেষ্ঠ কিংবা সহকর্মী কেউ এগিয়ে আসতে চাইলো না বিষয়টাতে । উল্টো দু'একজন রসিক মন্তব্য করে বসলো, তারকা হবার পূর্বলক্ষণ দেখছি! অনেক অনেকদিন আগে একরকম পালিয়েই বিয়ে করেছিলাম আমরা । সংসারের সবার অমতে। তখন সময়টা ছিল সেরকম। এখনকার মতো অভিভাবককে সরাসরি বোঝানোর দুঃসাহসিকতার চেয়ে, একা একা সিদ্ধান্ত নেয়া ছিল অনেক সহজ । তারপর সময় বুঝে অভিভাবকের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করলে হয়ে যেতো সমাধান । দুলাভাই গোত্রীয় লোকজন দেখা হলেই বলে বসতো প্রথম প্রথম । কী ব্যাপার, দাওয়াত দেবার ভয়ে এই কুবুদ্ধি! আমরা হাসতাম । দাওয়াতের ভয় না, দাবড়ানি খাবার ভয়ে বলিনি । দাবাড় দিয়ে আর লাভ কি । দুই গরু এক লাঙ্গলে বাঁধা থাকলে শত দাবড়ানোতেও একদিকেই দৌড়ায় । বাঁধা তো এবার শেষ । এখন তো দেখছি দৌড় শুরু । ১৬৪
সাবধান দৌড়াতে গিয়ে দড়ি ছিঁড়ে ফেলো না আবার কিন্তু । কথায় কথায় এটা সেটা এলোমেলো উত্তর দিলেও, অনেক কথাই তখনো স্পষ্ট বুঝতাম না আমরা । দড়ি কী? কীসের দৌড়? কেমন বাঁধা? আজ বহুদিন পর মনে হতে লাগলো, আসলেই তো জীবনের দৌড়ে সামনে এগোতে গিয়ে কখন যে দড়ির বাঁধন ছিঁড়ে গেছে, তা খেয়াল হয়নি কারও । সংসার জমি চাষ করার যে অতি প্রাচীন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দুই দ্বিপদ প্রাণীর ওপর একসাথে অদৃশ্য বাঁধনে বেঁধে, তা ছিঁড়ে দুজন দুদিকে চলে যেতে চাইলে কী করে ফলবে সোনার ফসল । বিয়ের পর প্রথম বছরগুলোতে কেমন যেন উড়ন্ত পাখির মতো মনে হতো নিজেদেরকে । আজ এই ডালে বসি, তো কাল অন্য ডালে । পরশু গাছই বদল । যেখানে যাই, যেভাবে যাই সেভাবেই কেমন যেন ভালো ভালো লাগে । বৃহস্পতিবারের এক হরতালের ছুটি পেয়ে সোজা চলে গেলাম রাঙ্গামাটি । পাহাড় দেখে নবীনা তো অবাক । এত বিশাল বিশাল গাছ! মাটির নিচ থেকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আসে কীভাবে? যেভাবে তোমার জন্য আমার ভালোবাসা উঠে আসে হৃদয় থেকে । এত দূরের পথ! এরপরও একটা পাহাড়কে আরেকটা পাহাড়ের এতো কাছাকাছি মনে হয় কিভাবে? যেভাবে তোমার জন্য আমার স্বপ্নগুলো স্থান করে নেয় বাস্তব থেকে । এত উঁচু উঁচু পাহাড়! তবুও মেঘ ছুঁতে পারে না কেন? যেভাবে তোমার কাছে কাছে থেকেও তোমার হৃদয়কে ছুঁতে পারি না সর্বক্ষণ । চলে গেলাম ঝুলন্ত ব্রিজের পার ঘেঁষে কাপ্তাই লেকে । সেখান থেকে নৌকা করে সুদূর সুলভং পাহাড়ি ঝরনা । নবীনা জেদ ধরলো ঝরনার পানিতে সান্ধ্যস্নানের । বিকেলের ক্লান্ত সন্ধ্যায় কাপ্তাই পাহাড় আর গোধূলির নীরব নিসর্গ, এরই মাঝে পর্যটকদের বিরক্তিতে আমরা নেমে পড়লাম ঝরনার ঝিরিঝিরি জলে । ১৬৫
স্বর্গ কী এতটাই দূরে! মনে হয়নি সেদিন। ওই তো, ওই উপরের পাহাড়ের দিকে তাকালে ঝরনার যে উৎসমুখটা দেখা যায়, ওইখানেই পানিতে আছে মেনকা, উর্বশী, রম্ভাদের মতো স্বর্গের অপ্সরাদের দল । নতুবা শুধু জলের সামান্য ধারায় এত মোহময়তা! শেষদিন ঢাকা ফিরে আসবার আগে ঘুরতে গেলাম বনভান্তের বৌদ্ধ বিহার । সংসারধর্ম ছেড়ে জীবনভর চিরকুমার থাকার ব্রতে প্রত্যয়ী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাথে কথা বললাম অতি বিরক্তিতে । বনভান্তে সকলের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন, মনে রাখবা, আমরা সবাই মরণ পথের যাত্রী। আমরা সবাই মরণ পথের যাত্রী । ফিরবার পথে নবীনা মুখ ভেংচালো । মনে রাখবা, আমরা সবাই পাত্র ছাড়াই পাত্রী । আমরা সবাই দল ছাড়াই নেত্রী । এটা একটা কথা হইলো! আমি সারারাত কারণ ছাড়াই রাঙ্গামাটির পর্যটন কমপ্লেক্স সংলগ্ন ঝুলন্ত ব্রিজে বসে বসে এক আকাশ তারা গুনলাম নবীনার কোলে মাথা রেখে । পরিকল্পনা ছাড়াই একবার মে মাসের ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পা বাড়ালাম সেন্টমার্টিনের পথে । সি-ট্রাক কিংবা সমুদ্রজাহাজের তোয়াক্কা না করে উঠে বসলাম সাধারণ ট্রলারে । মাঝ সমুদ্রে নষ্ট হয়ে গেল ট্রলারের জং ধরা ইঞ্জিন । উত্তাল ঢেউ আর তীব্র সি-রোলিংয়ে ট্রলার ডুবো ডুবো প্রায় । নবীনা হাসতে লাগলো, শোন, নৌকা ডুবে গেলে তুমি কিন্তু বেশি লাফালাফি করবে না । কেন? আমিও সাঁতার জানি না, তুমিও না । সুতরাং সোজা সমুদ্রের নিচে চলে যাবো । এরপর মৎস্যকন্যা-মৎস্যপুত্র হয়ে সবাইকে আটকে ধরবো নিচ থেকে, নো টাইটানিক, নো কেট উইন্সলেট । একসাথে না বাঁচি, মরতে তো পারবো শান্তিতে । আমি নৌকার মাঝিদের হাত-পা ধরতে লাগলাম । ভাই ব্যবস্থা করেন । লাইফ জ্যাকেট দেন । মাঝিরা আল্লাহ আল্লাহ করতে বললো । আমি হেল্প হেল্প বলে গলাফাটা চিৎকার করতে লাগলাম মাঝ সমুদ্রে । ১৬৬
সেন্টমার্টিনের রুক্ষ বালুভূমিতে কী এক অজানা আকর্ষণেই সাতদিন থেকে গায়ের চামড়া সাদা থেকে পুড়িয়ে পূর্ণ কালোতে পরিণত করে ফেললাম দুজনে । একেকটা বন্য ঢেউয়ের ধাক্কা খেয়ে জ্যান্ত প্রবালে হাত-পা কেটে রক্তারক্তি হয়ে গেল কখনো কখনো । সারাটা বিকেল লাল কাঁকড়ার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে অবসন্ন নবীনা, সন্ধ্যায় সূর্যডোবার আগে আগেই শুয়ে পড়তো সানবেডস্বরূপ উদার বালু বিছানায় । দেখ, দেখ, এক্ষুনি সূর্যটা টুক্ করে ডুবে পড়বে সমুদ্রের ভেতরে । আমি অবাক হয়ে আধশোয়া মাথা বাঁকা করে দেখতাম সে দৃশ্য । আসলেই তো দিবসের কি তেজদীপ্তময় গনগনে সূর্য অথচ সন্ধ্যায় তার কি করুণ পরাজয় ! দিন অনেক পেরিয়ে গেছে । সময় অনেক বদলে গেছে । কিন্তু সেই সেন্টমার্টিনের ক্লান্ত সূর্য, সেই রাঙ্গামাটির সুউচ্চ পাহাড়, এরা কী ঠিক আছে এখন? তাহলে, তাহলে নবীনা ঠিক নেই কেন? তাহলে সমুদ্রই সূর্য দেবতাকে ধরে রাখতে পারছে না কেন নিশীথ রাতের কালো থাবার আড়াল করে? চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার আগে আমি কয়েকবার নবীনার সাথে সংক্ষিপ্ত কথা বলার সুযোগ পেলাম । প্রতিবারই নবীনা অনড় । সিদ্ধান্তকে কী আরেকবার বদলানো যায় না নবীনা? বদলিয়েই এটা সর্বশেষ করা হয়েছে । তুমি কী আমার দিকটা একবার ভাববে? তোমার দিকটা ভেবেই এটা করা । কোন দিকটা । এইতো তোমার খ্যাতি, তোমার উন্নতি, তোমার ক্যারিয়ার। তুমি তোমার ক্যারিয়ার গড়বে, আমি আমারটা। তুমি তোমার কাজকে মূল্য দেবে, আমি আমার মনকে । ডিসেম্বরের বারো তারিখ আমার ফ্লাইট । আশা করি দিনটি তোমার মনে আছে । আমি মনে করতে লাগলাম কুড়িগ্রাম অডিটরিয়ামের সেই বারোই ডিসেম্বরের কথা। সেদিন হঠাৎ করেই এক আকাশী জামাপরা পরী চলে এসেছিল ১৬৭
কোনো এক অজানা রাজ্য থেকে একটা কাগজ হাতে নিয়ে । আবার বহুদিন পর হঠাৎ করেই সে চলে গেল আরেকটা কাগজ পৌঁছে দিয়ে । পৃথিবীতে কাগজের চেয়ে মূল্যবান বস্তু আর কী হতে পারে, যদি তাতে লেখা থাকে হৃদয়ের সব গহিন শব্দভাণ্ডার! ১৬৮
ডিসেম্বরের বারো তারিখ । আমি আর তিতাস গাজীপুর এসেছি ন্যাশনাল পার্কে । কর্মহীন জীবনে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাফেরা । ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান । ঘন পত্র-পল্লবে পরিপূর্ণ বিশাল বনানী । এরই মাঝ দিয়ে এখানে ওখানে হারিয়ে যাবার মতো এলোমেলো মেঠোপথ । একটু এগোলেই মনে হয় শেষ । কিন্তু শুরু আবার সেখানেই । তিতাস একটা উঁচু টাওয়ার দেখালো । চল্ উঠে পড়ি । উপর থেকে বন দেখবো । উঠে পড়লাম একশত ফুট উঁচু একটা পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে । আমি অবাক হয়ে তাকালাম বনের দিকে । এতো দেখি সবুজ সমুদ্র । সীমাহীন সবুজ জলরাশি । অবশ্যই, অবশ্যই সবুজ জল । দেখছিস, কেমন ঢেউয়ের মত দোল খাচ্ছে গাছগুলো । উঁচু থেকে সবকিছু এমন দেখায়? তিতাস আমার দিকে চোখ ফেরালো, হয়তো সেরকমই হবে । আমরা কি সবাই দুলছি? স্রোত একটাই, দোলা তো লাগবেই । ছোঁয়া যায় না হাত দিয়ে? খুব ধরতে ইচ্ছে করছে ঢেউগুলোকে । ভালোবাসায় ঢেউ ছোঁয়া যায় না রে। ছুঁলে অ্যান্টিগোনে হতে হয় । ধরলে আস্তিনের মতো নিঃশেষ হয়ে যায় । আমি আকাশের দিকে তাকালাম । দূর থেকে একটা বিশাল সাদা মেঘ ভেসে আসছে আমাদের টাওয়াটার দিকে । সেই মেঘের একটা কালো ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে সবগুলো গাছ ছুঁয়ে ছুঁয়ে । তিতাস ছায়ার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো । দেখেছিস্, সামান্য বিন্দু বিন্দু জল অথচ কি বিশাল তার কালো ছায়া। ১৬৯
আমি বললাম, আসলেই, জল হতে নেই রে। জল হলে হাওয়ায় ভাসতে হয় । ঠিক বলেছিস, জল হলে সবার চোখে চোখে থেকে সবাইকে কাছে টেনে দূরে চলে যেতে হয় । মনে আছে, আমরা যখন প্রাইমারীতে পড়তাম তখন হঠাৎ দূরে প্লেন দেখলে দৌড়ে চলে যেতাম ক্লাস ছেড়ে । স্যাররা বেত দিয়ে মেরেও ঢুকাতে পারতেন না ক্লাসে । ছোট্ট মন অথচ দূরের প্রতি কি বিশাল আগ্রহ । এখন কয়টা বাজে? আমি মোবাইলের দিকে তাকালাম । দুপুর এগারোটা চল্লিশ । আর কিছুক্ষণের মধ্যেই নবীনার প্লেন এয়ারপোর্ট ছাড়বে, তাই না । আবারও কিছুক্ষণ নিরব কাটালাম আমরা। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম একের পর এক মেঘ আসা যাওয়ার দৃশ্য । তিতাস টাওয়ারের প্লাস্টার উঠে যাওয়া দেয়ালের দিকে তাকালো । কে যেন বড় বড় করে লিখে রেখেছে, তমাল+মলি = ভালোবাসা । আমি বললাম, ভালোবাসা এমনটাই । দূরে থাকলে যোগ দিতে ইচ্ছে করে । আমরা সবাই দূরে চলে যাই কেন, বলতো? আলোর কাছে থাকলে আলোকে দেখা যায় না, অন্ধকার মনে হয় । দূরে চলে গেলে অন্ধকার থেকে সব আলোকে দেখা যায় । মনে আছে আমাদের ইংরেজীর রোকেয়া আপা একটা কথা বলতো, When object is in light, its image is dark. But when object is in dark, its image is enlighted. চল, রোকেয়া আপার বাসায় যাবি একদিন? কোথায়, কুড়িগ্রামে? হ্যাঁ, কুড়িগ্রাম । যাবো তবে আপার বাসায় না। তৃপ্তিকে দেখতে। মনটা কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে কয়েকদিন। ১৭০
আমি আর তিতাস রাতের ট্রেনেই কমলাপুর থেকে উঠে পড়ি কুড়িগ্রামের উদ্দেশ্যে । লালমনিরহাট পর্যন্ত আন্তনগর যায় আমাদের। কুড়িগ্রাম থেকে লালমনিরহাট ত্রিশ কিলোমিটার দূরে । কিন্তু সেখানেই নেমে পড়ি আমরা । বাসে চড়তে ইচ্ছে করে না । দম বন্ধ বন্ধ লাগে তিতাসের । সোজা হাঁটতে শুরু করি রেললাইন বরাবর । ক্লান্ত হয়ে পড়লে কখনো এখানে-ওখানে থেমে পড়ি আমরা । ব্যস্ততা তেমন কিছু নেই । পায়ের কাছে রেলের বিছানো দু'একটা পাথর হাতে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে মারে তিতাস । দোস্ত, কেন্দ্রাতিগ বল কাকে বলে, মনে আছে? আমি মাথা নাড়ি । The resultant force that causes an object to move in a circular path, which acts always towards the centre of the circular path is called the centripetal force. হ্যাঁ, সেই কবে ক্লাস নাইনে পড়েছিলি, তারপরেও ভুলিসনি দেখছি । আমি আবারও বলি According to newtons third law a centripetal force is equal to a centrifugal force. তিতাস হাসে, মুখস্ত রাখার ক্ষমতা অসাধারণ ছিল তোর । তবে বুঝে পড়তি না সবকিছু । বুঝলেও কি লাভ বল! ঢিলমারা পাথরটা কী কেন্দ্রাতিক বলের চেয়ে কেন্দ্রাভিগ বল বেশী পায়? তিতাস প্রশ্ন করে, আমরা কী পাথরটা? নাকি সমাজের সবাই আমাদের কাছে পাথর । বুঝি না । একটু আগেই তো বললি বুঝি না । আসলেই আমি সত্যি বুঝি না দোস্ত । আমি উদাসভাবে দূর ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকি । তিতাস রেলের লোহার পাতের উপর কিছুক্ষণ দৌড়ে যেতে চায় ছোটবেলার মতো । আমি হাসি । মৃদু হাসি । ওকে ডাক দেই । এই তিতাস, পড়ে যাবি । ও উল্টো আমাকে টান দেয়। দোস্ত! তুই পাশের লাইনটায় উঠ । দৌড় দে । হেব্বি জোস । ১৭১
আমি ওর কথা ফেলতে পারি না । পাশের রেলে উঠে পড়ি । কিন্তু একটু যেতে না যেতেই পিছলে পড়ে যাই ধপাস্ করে । তিতাস হাসে, তোর শালার পড়ার অভ্যাস এখানো গেলোনা । কখনো বাইসাইকেল থেকে, কখনো রেললাইন, কখনো টেবিল । দেখ, আমার দু'জন লাগে । আয় হাত ধর । দেখিস বহুক্ষণ থাকতে পারবো একসাথে । তিতাস কাছে আসে । দীর্ঘক্ষণ আমি আর ও হাতে হাত রেখে ছেলেবেলার মতো হাঁটতে থাকি রেললাইন বরাবর । তিতাস আবৃত্তি শুরু করে । Whose woods these are I think I know. His house is in the village, though; He will not see me stopping here To watch his woods fill up with snow...... The woods ae lovely, dark, and deep, But I have promises to keep, And miles to go before I sleep, And miles to go before I sleep. জানিস, রেল লাইন ধরে হাঁটতে থাকলে কেন যেন আমার জহরলাল নেহেরুর এই প্রিয় কবিতাটা মনে পড়ে সবসময় ! এই বন কার জানি বলে মনে হয় । বুঝি বাড়ি তার ঐ গাঁয়ে নিশ্চয়; জানবে না সে তো দেখছি দাঁড়িয়ে আমি বন তার হলো এখন তুষারময়..... কাজল গভীর এ-বন মধুর লাগে, কিন্তু আমার ঢের কাজ বাকি আছে । যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে, যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে । (Stopping by woods on a sonwy evening, অনুবাদ, শামসুর রাহমান, রবার্ট ফ্রস্টের নির্বাচিত কবিতা, বাংলা একাডেমী ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর ১৯৬৮ইং ।) ১৭২
অকারণে এখানে ওখানে বসে চা নামের অখাদ্য গরম পানি খেয়ে দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দেই দুইজনে । এটা সেটা হাতে নিয়ে অনেক রাতে কুড়িগ্রাম পৌঁছে যাই আমরা । মাঝরাতে আমাদের দেখে বিরক্ত হয় তিতাসের বোন । এইসব কি তিতাস, তোকে না বলেছি আর কোনদিন আসবি না এখানে! তৃপ্তিকে দেখতে এলাম আপা । তিতাস মাথা চুলকায় ৷ দেখার মতো কী আছে? ও কী চিড়িয়াখানার জন্তু? জন্তু হলি তোরা । তুই আর তোর এই উন্মাদ বন্ধুটা । তোদের দুইটাকে ধরে চিড়িয়াখানার খাঁচায় বন্দি করে রাখা দরকার । আমি চুপচাপ থাকি । হাসি, বেকুবের মতো হাসি । আপা রেগে যায় । এই ছেলে, তুমি আর কখনো আমার বাসায় আসবে না । তিতাস মধ্যস্থতা করে । একটা পাথর এনেছিলাম তৃপ্তির জন্য আপা । কী এনেছিস, পাথর? ছোটবেলায় তৃপ্তি পাথর খুব পছন্দ করতো । ওকে দিয়েই চলে যাবো । আপা রাত দুইটায় বিরক্তি মুখে ডেকে দেয় তৃপ্তিকে ৷ তৃপ্তি চোখ ঘষতে ঘষতে হাজির হয় আমাদের সামনে । তিতাস এগিয়ে যায় । গোল করোনা, গোল করোনা, ছোটন ঘুমায় খাটে এই ঘুমকে কিনতে হলো নওয়াব বাড়ির হাটে । সোনা নয়, রুপা নয়, দিলাম মতির মালা তাই তো ছোটন ঘুমিয়ে আছে.... বাবা, তোমার গায়ে এরকম গন্ধ কেন? তিতাস হাসে । গন্ধ গন্ধ গন্ধ আমার গায়ে গন্ধ তোমার নাক বন্ধ আমার তৃপ্তি মন্দ । তৃপ্তি লাফিয়ে উঠে । উহুঁ, উহুঁ, এটা না, এটা না । ১৭৩
তোমার নাক বন্ধ কবি আংকেল মন্দ । কবি আংকেল মন্দ ৷ এদফায় আমিও যোগ দেই ওদের সাথে । হয়নি, হয়নি মিল হয়নি ছন্দ । আমরা সবাই অন্ধ । তৃপ্তি হেসে উঠে । আচ্ছা কবি আংকেল তুমি কি নজরুলকে চেন? তিতাস পাশ থেকে ইন্টারফেয়ার করে। অবশ্যই চেনে । ওর বাসায় নতুন কাজের ছেলেটার নাম নজরুল । ইয়া লম্বা লম্বা চুল আর কি কালো কুচকুচে দাঁত । কেন, দেখবি নাকি একদিন? বাবা, তুমি না আসলে কিছুই বুঝ না । এটা তো সেই নজরুল না । তাহলে কে? এটা হলো কবি নজরুল । ও সেই লম্বা লম্বা চুল । রাখে নাই দাড়ি, রাখিয়াছে চুল । আচ্ছা বাবা, তুমি দাড়ি লাগিয়েছ কেন? তিতাস হো হো করে হেসে উঠে । এটা লাগাতে হয় না । এমনি লেগে যায় বুঝলি ৷ আমাদের হাসি শুনে দুলাভাই বেড়িয়ে আসেন পাশের বেডরুম থেকে । কি ব্যাপার, দিনরাতের হিসাবও কি ভুলে গেছো নাকি? তিতাস মাথা নিচু করে । দুলাভাই কথা বন্ধ করেন না । আদব-কায়দা, চাল-চলন যা নষ্ট হবার তা তো বহু আগেই করেছো । এখন বাকি শুধু মেয়েটা । দরকার হলে পাশের ঘরে শুয়ে পড় । সকালে উঠে সোহাগ দেখিয়ো । সময়ে কাজ নেই, অসময়ে বাবাগিরি । আমি আর তিতাস রেললাইন থেকে কুড়ানো পাথরটা তৃপ্তির হাতে দিয়ে চলে আসি আপার বাসা থেকে । তৃপ্তি পাথরটা দুই হাতে শক্ত করে ধরে । ইমা, এত্ত সুন্দর পাথর! গভীর রাতে ধরলা নদীর পারে গিয়ে বসে পড়ি আমরা । নৌকা খুঁজি । নিশি ভ্রমনের নৌকা । পাওয়া যায় মাছ ধরা জেলেদের। উঠে পড়ি ওদেরই ১৭৪
একটাই । জলিল বিড়ি আর মাছের গন্ধ মিলিয়ে এক অদ্ভুত নেশা তৈরি হয় মাঝ নদীতে । তিতাস আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, বাপরে, রাতের আকাশে এত তারা দেখা যায়! আমি মৃদু হাসি। রাত তো তাই । অন্ধকার না হলে আলো দেখবি কিভাবে! তিতাস সাজির বিয়ে হয় একটা আলো জ্বলজ্বলে পূর্ণিমার রাতে । একটা আস্ত চকচকে রূপালী চাঁদ এমন আলো চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে যে, দেখে মনে হয়, আঁধার করা আলো । রূপকথার মৃত্যুর ঠিক কতোদিন পর খেয়াল রাখিনি, তবে যতদূর মনে পড়ে সে রাতেও ছিলো এমন উজাড় করা আলো । চোখ বন্ধ করা অন্ধকার । তিতাসের মেয়ে তৃপ্তি এখন তাজমহল রোডেই থাকে । ওর নতুন নানার বাড়িতে । তেমন একটা যাওয়া হয় না ওদের নতুন সংসারে । হাজারো হোক শ্বশুরবাড়িতে থাকা জামাইয়ের বাড়ি, এক কথায় ঘরজামাইদের বন্ধু-বান্ধব যতো কম হয় ততোই ভালো । শুধু একদিন ওদের ম্যারিজ ডে-তে আমন্ত্রণ দিয়েছিল আমাকে । আমি একটা কাগজে লিখে দিয়েছিলাম একটা অতি পুরাতন ডায়ালগ । কাবাব পল্লীর উন্মুক্ত আকাশের নীচে বসে তিতাসের দেয়া সেই অশ্রু ভেজা কণ্ঠ— 'সাজি, আমি এতো কিছু জানিনা । শুধু এইটুকু জানি, আমি তোমাকে চাই । পৃথিবীর সবকিছু দিয়ে হলেও, পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃস্ব ব্যক্তি হয়ে হলেও শুধু তোমাকেই চাই ।’ ১৭৫
(মূল কাহিনীর জন্য এই অংশটুকু জরুরী নয় । পাঠক অনায়াসে স্বেচ্ছায় বাদ দিতে পারেন এটা ।) আমি মাঝে মাঝে ঘুরতে বের হই । একা একা । কখনও কখনও একটা লেইস্ চিপস্ নিয়ে সোজা চলে যাই তুরাগের পারে । খাই না । দীর্ঘক্ষণ হাতে নিয়ে বসে থাকি । উত্তরা থার্ড ফেজের উপর ধরে এয়ারপোর্টের পেছন দিয়ে প্লেন উড়ে যায় । কারণহীনভাবেই ছোটবেলার মতো দু'একটার দিকে লম্বা সময় তাকিয়ে থাকি দিগন্তে মিলিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত । সবাই উড়তে চায় । কেউ স্বপ্নের আকাশে পাখি হয়ে, কেউ ঘুড়ি হয়ে, কেউ উড়োজাহাজের ডানার ওপর ভর করে । দীর্ঘদিন পর শিবলী বাংলাদেশে বেড়াতে এলো একবার । রূপালী জামাপড়া ফুটফুটে একটা মেয়ে ওর হাত ধরে আছে। আমি মেয়েটার দিকে অরাক হয়ে তাকালাম । কোথায় যেন দেখেছি মেয়েটাকে! মানুষ কাছে আসে দূরে চলে যাবার জন্য । কারণ দূরে চলে যাওয়াটাই তার ধর্ম । ১৭৬
আমি অনেকদিন ধরে খেয়াল করে দেখছি যে বাড়ির সকলে আমাকে কিছু দেবার সময় এক চোখোমি করে। বাবা, মা, দাদীমা, ফুপু, নোটন ভাইয়া, ঝোটন ভাইয়া সবাই। এমনকি বাড়ির কামলা জয়তুনের মা পর্যন্ত । এ অবিচার আজ থেকে না অবশ্য। আমার ছোটবেলা থেকে এইরকম চলছে। অথচ সবাই জানে আমার কত বুদ্ধি ! ইসকুলে যাই নে ঠিকমত, ইসকুল আমার ভাল লাগে না, তবু ক্লাসে অঙ্কে একশ'র মধ্যে একশ' কেবল আমিই পাই ৷ মা আমার চেয়ে নোটন ভাইয়া ঝোটন ভাইয়াকে বেশি আদর করে, খেতে দেবার সময় ওদের বেশি বেশি করে দেয় ; বাবা পয়সা দেবার সময় নোটন- ঝোটন ভাইয়াকে দেয় পঞ্চাশ পয়সা, আর আমাকে মাত্তর পঁচিশ, তবু ওরা অঙ্কে আমার চেয়ে কত কম পায় ৷ আমি অনেকদিন ধরে খেয়াল করে দেখছি যে বাড়ির সকলে আমাকে কিছু দেবার সময় এক চোখোমি করে। বাবা, মা, দাদীমা, ফুপু, নোটন ভাইয়া, ঝোটন ভাইয়া সবাই। এমনকি বাড়ির কামলা জয়তুনের মা পর্যন্ত । এ অবিচার আজ থেকে না অবশ্য। আমার ছোটবেলা থেকে এইরকম চলছে। অথচ সবাই জানে আমার কত বুদ্ধি ! ইসকুলে যাই নে ঠিকমত, ইসকুল আমার ভাল লাগে না, তবু ক্লাসে অঙ্কে একশ'র মধ্যে একশ' কেবল আমিই পাই ৷ মা আমার চেয়ে নোটন ভাইয়া ঝোটন ভাইয়াকে বেশি আদর করে, খেতে দেবার সময় ওদের বেশি বেশি করে দেয় ; বাবা পয়সা দেবার সময় নোটন- ঝোটন ভাইয়াকে দেয় পঞ্চাশ পয়সা, আর আমাকে মাত্তর পঁচিশ, তবু ওরা অঙ্কে আমার চেয়ে কত কম পায় ৷ ৭
এইসব অবিচার বহুদিন থেকে এই তালুকদার বাড়িতে চলে আসছে, কিন্তু মুখে বললে কেউ স্বীকার করবে না। বরং হা-হা করে তেড়ে আসবে আমার দিকে । আমার একমাত্তর বন্ধু হচ্ছে, এই এলাকার মধ্যে, চুমকি। চুমকি আমার দূর সম্পর্কের ফুপাতো বোন। ওর মা সালেহা ফুপু হচ্ছে আমার আপন ফুপুর চেয়েও ভাল। আমাকে খুব আদর করে। আচার খেতে দেয়। তিলের নাড়ু খেতে দেয়। আমাদের পাশের বাড়িতে ওরা থাকে । কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই যে বছরের মধ্যে নয় মাসই চুমকির সঙ্গে আমার আড়ি চলে। একমাস মাত্তর ভাব। এত অল্প ভাব নিয়ে কোন বন্ধুত্ব হয় ; বলো? তবু চুমকি আমার বন্ধু। ওর মতন হিংসুটে আর কুট কচালে এই এরিয়াতে কেউ নেই, তবুও আমার বন্ধু। আমার চেয়ে ও বয়সে বড়, তবু বন্ধু। আমরা দু'জনে গ্রামের ইসকুলে এক কেলাসে পড়ি । চুমকি বলে, আমিও নাকি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু একথা খুব কম বলে । বেশির ভাগ সময় আমাদের আড়ি থাকে তো, তাই। সেদিন থাকতে না পেরে চুমকিকে মনের দুঃখের কথাটা বললাম । শুনে চুমকি খ্যাক্ করে উঠল। বলল, ‘গাধার মতন কথা বলিস নে তো। মা-বাবা কোনদিন কাউকে কম আদর করে, হ্যাঁ ?' আমি বললাম, ‘করে না তো কি ? বাড়িতে মুরগি জবাই হলে আমি পাই মুরগির গলার নলি, গিলে, ড্যানা আর মাথা। মা বলে, এইগুলো খা, খেয়ে দ্যাখ্ কি মজা। আর নোটন ভাইয়া, ঝোটন ভাইয়াকে দেয় রান, বুকের সাদা গোসত। রানের গোসত খেতে কত স্বাদ তা জানিস, একেবারে নরম তুলতুলে।’ আমার কথা শুনে চুমকি নাক ঘোঁচো করে বলল, ‘এঃ, তাই বুঝি ? আমি তো বাপু রানের গোসত কোনদিন খাই নে। মুরগিগুলো বেঁচে থাকার সময় ঐ রানগুলো নেড়েচেড়ে আমাদের পায়খানার পিছনে ময়লা খুঁজে খায়। ওয়াক থুঃ।' ৮
শোন কথা ! এমন করে বললে কার না ঘেন্না লাগবে ? তবু আমি জিদ করে বললাম, ‘আর বুকের গোসত, তার বেলায় ?' শুনে চুমকি তক্ষুণি বলল, ‘আরো খারাপ। ময়লা খেতে খেতে হেঁদিয়ে পড়লে মুরগিরা বুক দিয়ে ঠেলে ঠেলে ওর ভেতরেই জায়গা করে নিয়ে বসে। বসে বসে ঝিমোয়।' নাঃ, চুমকির সাথে কথায় পারা যায় না। ওর সবটাতে একটা সব জান্তা ভাব। অথচ দেখ, দামড়ি হয়ে গেছে। তবু আমার সাথে এক কেলাসে পড়ে। বেশি কথা বলে দেখে ওর নাম দিয়েছি আমি পঞ্চমুখি। অবশ্য এটা ওর গোপন নাম। শুধু আমি জানি আর আমাদের ইসকুলের নফিসা জানে। হি হি হি। আমি বললাম, ‘আচ্ছা, তা না হয় হল, কিন্তু পয়সা দেবার বেলায় ? ওরা কেন পঞ্চাশ পয়সা, আর আমি পঁচিশ ? আমার কথা শুনে চুমকি বলল, 'আহারে, পয়সা নিয়ে তুই কি করিস, তা বুঝি মামা জানে না ? ভাজা খাবার নাম করে পয়সা চাইবি আর জমিয়ে জমিয়ে ‘খুনি কে’, ‘দস্যু বাহরাম' এইসব পড়বি। গঞ্জের হাটে সাধু চাচার বইয়ের দোকানে তোর জ্বালায় বই রাখতে পারে না। তোকে বেশি পয়সা দিয়ে লাভ কি মামার ? নোটন ভাইয়া ঝোটন ভাইয়াকে পয়সা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ওরা ননী ময়রার দোকানে বসে বড় বড় রসগোল্লা আর ক্ষীরের গুঁড়ো লাগানো চমচম কিনে খাবে। পেটে থাকবে। এইসব কথা শুনলে কার না রাগ হয়, বল ? আমি রেগে গিয়ে বললাম, “তুই ভাল সাজার জন্যে এমনি করে বলিস, তাই না ? আমি জানি, আমি মেয়ে বলেই ওরা এমনি ব্যাভার করে। যদি নোটন ভাইয়া, ঝোটন ভাইয়ার মতন ছেলে হতাম, তাহলে আমাকেও আদর করে বুকের গোসত, রান আর চাওয়া মাত্তর পঞ্চাশ পয়সা দিত।' চুমকিও একথা শুনে রাগ করে বলল, ‘আর তোর মতন নালুচে হলে বুঝি খুব ভাল হতো ? তোকে মোটাসোটা খাইয়ে আমার মামা-মামীর কি লাভ হবে, হ্যাঁ ? দু'দিন পরে তো ড্যাং ড্যাং করে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবি, ওখানে গিয়ে তো জাড়ি ঠেলবি রান্নাঘরে, মামা-মামীর কি কাজে লাগবিরে তুই ? ৯
তোকে খেতে দেয়া, পয়সা দেয়া, সবটাই তো লস্।” এইজন্যেই আমি চুমকিকে একেবারে দু' চোখে দেখতে পারি নে। মানুষের মনে এত কষ্ট দিয়ে কথা বলতে পারে যে কি বলব। আর ইংরেজি কথা। চুমকির বাবা শহরের কলেজে ইংরেজি পড়ায় তো, তাই চুমকি কথায় কথায় খামোকা ইংরেজি বলে। আর ইংরেজি আমার দু' চোখের বিষ। এরপরে ওর সঙ্গে আড়ি না দিয়ে আর থাকা যায়, বলো ? ১০
আমাদের বাড়িটা অনেক অনেক বড়। গোয়ালঘর, উঠোন, লেবুতলা, ধানের গোলা, বিচালি রাখার ঘর সব একবার করে পাক দিয়ে আসতে আমার রোজ অনেক সময় লাগে। আর আমার কখনো রাগ হলে আমি সবসময় বাড়ির মধ্যে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়াই আর আপন মনে কথা বলি । চুমকির সাথে আড়ি দিয়ে এসে আমি এমনি করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় দেখি নোটন ভাইয়ার সাথে সাথে দুটো ছেলে আমাদের বাড়ির মধ্যে ঢুকছে। আমি খেয়াল করে দেখলাম, ছেলে দুটো নোটন ভাইয়ার বয়সী। একজন নোটন ভাইয়ার মতন লম্বা আর একজন ঝোটন ভাইয়ার মতন গাটু গুটু। দু'জনেরই মাথাভর্তি চুল। একজনের চোখে আবার চশমা। মা তখন রান্নাঘরে বসে তরকারি কুটছে। কচি ঢেঁড়সের ভাজি হবে আজ। একটু আগে ক্ষেত থেকে আমি তুলে এনেছি আর জয়তুনের মা কুটে দিয়েছে। ১১
আমি আজ ইসকুলে যাই নি। ইসকুল অনেকদিন ধরে বন্ধ। পাকিস্তানি মিলিটারিরা পঁচিশে মার্চে আমাদের দেশ আক্রমণ করার পর থেকে ইসকুল বন্ধ হয়ে গেছে। এই একটা খুব ভাল কাজ হয়েছে ! এই ইসকুল বন্ধ। খামোকা সকাল থেকে হুড়মুড় করে পড়া সেরে, চান সেরে, নাকেমুখে গরম ভাত গিলে ইসকুলে যাওয়া। তারপর বসে বসে ঝিমোনো। দুপুর একটার মধ্যে সেকেন্ড স্যার আর হেড স্যার এই দু' জনেই একবার করে ঘুম সেরে নেয়। তারপর কার ক্ষেতে মুলো হয়েছে, কার ক্ষেতে বেগুন হয়েছে, কাদের বাড়ির চালকুমড়ো খেতে স্বাদ এইসব গল্প করে আমাদের সঙ্গে। তার মানে, আমাদের আবার সেইগুলো পরের দিন যোগাড় করে আনতে হয়। এইসব ধানাইপানাই আমার তাই ভাল লাগত না। তার ওপর ক'দিন আগে কারা যেন ইসকুলের চেয়ার, বেঞ্চি সব তুলে নিয়ে চলে গেছে। মা বলে, তারা নাকি শান্তিকমিটির লোক। শান্তিকমিটিরা নাকি পাকিস্তানিদের চর। আর পাকিস্তানিরা হচ্ছে আমাদের দেশের শত্রু। মা বলে, সব দেশেই নাকি ঘরশত্রু বিভীষণ থাকে। শান্তিকমিটির লোকেরা নাকি সেই ঘরশত্রু বিভীষণ। তা আমি কিন্তু মনে মনে খুব খুশি। স্যাররা আর আপামনিতো পালিয়েছে পঁচিশে মার্চের পরপরই। বই, চকখড়ি, স্লেট, ব্ল্যাকবোর্ড এসব হারিয়েছে সেই সঙ্গে। ইসকুলের কোন কিছুর জন্যে যদি আমার মায়া না হয়, তাহলে আমি কি করব বল ? সবগুলো বেঞ্চি ছিল নড়বড়ে। একদিকে আমি বসলে, অন্যদিকে চুমকি বা নফিসা না বসলে সেটা ঢেঁকির মতন উঁচু হয়ে থাকত। চুমকি আর আমি কতদিন এইরকম ঢেঁকি কুচকুচ্ খেলেছি। সে অবশ্য মজা হত অনেক তবে রোজ রোজ কার এসব ভাল লাগে, বল ? মিথ্যে বলব না, আপামনির জন্যে একটু কষ্ট হয় মনে। পারভীন আপামনি কিন্তু অতো রাগী না, বেশ মিষ্টি করে হাসত পড়া না পারলেও। তারপর আবার বুঝিয়ে দিত। ঐ ওর জন্যেই মনটা একটু কেমন কেমন করে। এই ঝামেলার মধ্যে ১২
কোথায় যে আপামনি হারিয়ে গেল। আমি এইসব ভাবছি আর ছেলে দুটো বাড়ির মধ্যে ঢুকে লাট্টুর মতন চোখ ঘুরিয়ে সেই যে সবকিছু দেখছে তো দেখছেই। এরা কাদের বাড়ির ছেলেরা গো ? আমি মনে মনে ভাবলাম। রহস্য আমার ভীষণ ভাল লাগে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যে রহস্যের গন্ধ পেলেই পেট কেমন গুড়গুড় করে আর নাক চুলকোয় ৷ আমি নাক চুলকোতে চুলকোতে ওদের দিকে হা করে তাকিয়ে দেখছি বলে কোত্থেকে ঝোটন ভাইয়া এসে আমার চুল টেনে বলল, ‘ঘরে পাটি পেতে দে শিগগিরই, হাবলি কোথাকার। ' শোন কথা ! আমি হাবলি ! আর উনি কি ? রাতদিন মা'র আদর আর মুরগির রান খেয়ে যে হোদল কুতকুত, সে কথা ওকে কে বলবে ? তবু বাইরের মানুষের সামনে আমি হৈচৈ করব, অতো বোকা না । এসবের বিচার পরে হবে। আমি দৌড়ে আমাদের শোবার ঘরে ঢুকে পাটি বের করে নোটন ভাইয়া-ঝোটন ভাইয়ার ঘরে পার্টি পেতে দিলাম। ছেলে দুটো ঝোটন ভাইয়ার পিছন পিছন এসে বসল ৷ এদিকে নোটন ভাইয়া দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে মায়ের কাছে উবু হয়ে বসে কিসব কথাবার্তা বলতে লাগল। মা নোটন ভাইয়ার কথা শুনে তরকারি কোটা বন্ধ করে ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর তাড়াহুড়ো করে বলল, “আহা, বাছারা না খেয়ে চলে যায় না যেন, আমার এক্ষুণি সব হয়ে যাবে!” তারপর আমার হা করা মুখের দিকে আড়চোখে চেয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘কেউ টের পায় না যেন, বিশেষ করে তোর বাবা। তাহলে তুমুল কাণ্ড হয়ে যাবে।' ব্যাপার কি ? সন্দেহ আমার ঘন হতে লাগল । মাকেই জিগ্যেস করব কিনা ভাবছি, দেখি মা-ই আমাকে হাত ইশারায় ১৩
কাছে ডাকছে। কাছে যেতে খুব মিষ্টি গলায় মা বলল, 'লক্ষ্মী সোনা পায়রা আমার, মাছগুলো দৌড়ে পুকুরঘাট থেকে ধুয়ে নিয়ে আয়।' জীবনে কতবার ভেবেছি মায়ের মিষ্টি কথায় কখনো ভুলব না, তবু এমন করে কথা বললে আমার মাথার মধ্যে সব কেমন ভণ্ডুল হয়ে যায়। মা কোন কাজ করাবার সময় সবসময় এমনি মিষ্টি করে কথা বলেতো, তাই এও আমার এক জ্বালাতন। অথচ মুরগি রান্না হলে - আমি কিছু না বলে একগাদা ছাই মাখানো কোটা কই মাছ ঝুড়িতে ভরে পুকুর পাড়ের দিকে দৌড়চ্ছি, ওমনি আমাকে থামিয়ে মা বলল, ‘আর শোন্ত, কেউ যদি জিগ্যেস করে আমাদের বাড়িতে অচেনা কোন লোক এসেছে কি না, তুই বলবি, না। মনে থাকবে ?’ মনে থাকবে না মানে ? মিথ্যে আমি খু-উ-ব বলতে পারি। তবে চুমকির চেয়ে একটু কম। ১৪
আমাদের বাড়িটার মেঝে আর দেয়াল সিমেন্টের, কিন্তু মাথায় টিনের চাল। গ্রামে যে কয় ঘর বড়লোক আছে, তাদের মধ্যে আমরা একজন। আমাদের চেয়েও বড়লোক অবশ্য লাইলী আপারা। লাইলী আপা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে। আমাদের বাড়ির চারদিকে শুধু গাছপালা। পূর্বদিকে তো রীতিমত জঙ্গল। জঙ্গলের ওপারেই কুলু কুলু স্বরে নদী বয়ে চলেছে। সন্ধে হতে না হতে আমাদের বাড়ি নিঝুম হয়ে আসে। বাঁশবাগানে শব্দ উঠে সর্ সর্ সর্। রাতজাগা কুয়ো পাখি অলক্ষ্মী ডাক ডাকে। দাদীমা তখন গায়ে চাদর জড়িয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে ফিফিস্ করে বলে, ‘ঐ শোন, শুনতে পাচ্ছিস? ওরা সব এবার বেরোবে! এইসব রাতে ওরা বেরোয়। পায়ে মল, উল্টো পায়ে হাঁটে, হাঁটার সময় ঝমঝম ঝমঝম করে মলের আওয়াজ হয়। একটু পরেই দেখবি আকাশের উত্তর-পূর্ব কোণে নীল আলো জ্বলে উঠবে। ঘিচিমিচি, ঘিচিমিচি করে কথা বলে ওরা, তুরুপ্ তুরুপ্ করে লাফ দেয়।’ ১৫
দাদীমার বয়স কত আমি জানি নে। চুমকি বলে, একশো। আমার বাবা দাদীমার শেষ সন্তান। আমার দাদীমার দশ বারোটা ছেলেমেয়ে ছিল, কিন্তু সব মরে গেছে। শুধু আমার এক ফুপু আর বাবা বেঁচে আছে। মা বলে, ‘একটু শোকে কাতর, অনেক শোকে পাথর।’ দাদীমা জীবনে অনেক শোক পেয়েছে তো, তাই সে আবোল-তাবোল কথাবার্তা বলে। আবার চোখেও দেখে না দাদীমা। কানেও শোনে কম। আবার রাগ আছে খুব। আমি তার পানের বাটা থেকে পানের বোঁটা চুরি করে খাই বলে আমাকে খুব বকা দেয়। বলে, যারা বোঁটা খায় তাদের নাকি জিব মোটা হয়ে যায়। আর নিজে যে পাঁচ মিনিট পান ছাড়া থাকতে পারে না, তার বেলায় কিছু না। আমাদের পুকুরঘাটের কথা বলি। পুকুরটা বেশ বড় আর নির্জন। ঘাটটা বাঁধানো, কিন্তু পুরনো বলে অনেকগুলো ধাপ ডেঙে গেছে। মা বলে, আমার দাদা নাকি এই ঘাট বাঁধিয়ে দিয়ে গেছে। পাড়ার অনেক মানুষ এই ঘাটে কাপড় কাচতে, গোসল সারতে আসে। আমাদের পুকুরের চারপাশ ঘিরে বড় বড় তাল আর খেজুর গাছ। একটু দূরে বাঁশবন। বাঁশবন ছাড়িয়ে কাঁঠাল বাগান। তারপর আম, জামরুল, লিচু আর আমড়া গাছ। তারপরে নিচু ঢালু একটা জমি, যেখানে চাষ হয়। সেটা পেরোলেই গহীন জঙ্গল। জঙ্গলের ওপারে নদী। নদীর ওপারে আর একটা গাম ৷ আমি পুকুর ঘাটের সবচেয়ে নিচু সিঁড়িতে বসে মাছ ধুচ্ছি, এমন সময় দেখি কফিলউদ্দিন চাচার বাড়ি থেকে লাইলী বু একগাদা জামাকাপড় নিয়ে ঘাটে নামছে কাচবে বলে । লাইলী বু শহরে থাকে। এবার এস.এস.সি পরীক্ষা দেবে। পড়াশোনায় খুব ভাল লাইলী বু। আর কি সুন্দর দেখতে। ফর্সা, লম্বা চুল, টানাটানা চোখ কাজল না পরলেও মনে হয় যেন দু'চোখে কাজল পরেছে লাইলী বু। আমি এই পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালবাসি লাইলী বুকে। কিন্তু সে তো এখানে থাকে না, মাঝে মাঝে আসে। লাইলী বু’র বাবা গ্রামে থাকে। কিন্তু লাইলী বু’র ভাই ১৬
থাকে সৌদি আরবে। সে অনেক টাকা পাঠায় লাইলী বু’কে, আর লেখাপড়া করতে বলে! পঁচিশে মার্চের পর শহর থেকে গ্রামে নিয়ে এসেছে লাইলী বুম্বকে তার বাবা। ওখানে হোস্টেলে মেয়েরা আর থাকে না, কলেজও বন্ধ, আর খুললেও লাইলী বু যাবে না বলেছে । এই গ্রামে পঁচিশে মার্চের পরপর একবার পাকিস্তানি মিলিটারিরা এসে উৎপাত করে গেছে, এখন আর করে না। সবাই বলছে, একবার যেখানে ক্ষয়ক্ষতি করে গেছে, সেখানে আর আসবে না তারা। আমাদের গ্রামের অনেক লোক আগে পালিয়ে গিয়েছিল জানের ভয়ে, এখন তারা আবার একজন একজন করে ফিরে এসেছে। নিজের বাড়িঘর আর জমির মায়া মানুষের খুব বেশি, মা বলে। মা বলে আমি যদি মন দিয়ে লেখাপড়া করি তাহলে আমাকেও সে শহরে বিজ্ঞান পড়তে পাঠাবে। কিন্তু ইসকুল যে আমার একদম ভাল লাগে না, একথাটা মা'কে এখনো বলতে পারি নি ভয়ে। মা এখনো আমাকে মাঝে মাঝে মারে, চুলোয় আগুন জ্বালাবার বাঁশের ফুঁকনিটা দিয়ে। মা বলে, আমি নাকি পাঁজির পা ঝাড়া। মাঝে মাঝে নাকি আমার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অথচ দেখ, তোমরা দেখতেই পাচ্ছ, আমি কত লক্ষ্মী, এখন ঘাটে বসে ছাই মাখানো একগাদা কইমাছ ধুচ্ছি। দুটো কইমাছ অবশ্যই ধুতে গিয়ে হাত থেকে টুপ করে পড়ে গেছে, খুঁজতে গেলে জামাকাপড় ভিজে যাবে তাই আর সেসব চিন্তা করছি নে। তবু আমি বাড়ির অনেক কাজ করে মা'কে সাহায্য করি । আমাকে মাছ ধুতে দেখে লাইলী বু বলল, 'কিরে পায়রা, কোথায় থাকিস আজকাল ? গল্পের বই নিতে আসিস নে ব্যাপারটা কি ? খালাজানের শরীর কেমন, ভাল তো ?' লাইলী বু'র এই একটাই দোষ, কথা জিগ্যেস করার সময় একগাদা জিগ্যেস করবে। কিন্তু উত্তর শুনতে চাইবে না, আবার অন্য কথা পাড়বে। ১৭
তবু লাইলী বুকে সবাই ভালবাসে। যখন এখান থেকে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিল লাইলী বু, তখন ইসকুলের হেড স্যার, সেকেন্ড স্যার বাড়ি বয়ে এসে লাইলী বু’কে পড়িয়ে দিয়ে যেত, বিনা পয়সায়। এ এক অবাক কাণ্ড ! আমার বেলায় স্যারদের তিন হাত লম্বা বেত আর লাইলী বু'র বেলায় ছিল - নাঃ, বেশিক্ষণ কঠিন চিন্তা করলে আমার মাথা গুলিয়ে যায়। আমি তাই কোন কথার উত্তর না দিয়ে আপন মনে মাছ ধুচ্ছি, ওমনি লাইলী বু অন্য কথা পেড়ে ফেলেছে। বলল, 'বুঝলি রে পায়রা, আমাদের এদিককার অবস্থা আবার খারাপ হয়ে এসেছে। এই তো মাত্তর ক'দিন আগে পাকিস্তানি মিলিটারিরা ছুটিপুর গ্রামে ঢুকে হঠাৎ আগুন জ্বালিয়ে গ্রাম ছারখার করে দিল। দালাল পুলিশ আর বিহারীরা তাদের সাহায্য করল। কি অবস্থা বুঝে দ্যাখ্।' আমি আর বুঝে কি করব। বরং লাইলী বু'র কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, 'আমাদের কি হবে লালী বু ? ' লাইলী বু সাহস দিয়ে বলল, 'অতো ভয় পানে। আমাদের মুক্তি ফৌজের কমান্ডার ক্যাপ্টেন খোন্দকার নজমুল হুদা তার বদলা নিয়েছেন ভাল করেই। সেদিনই উনি তার সৈন্যদের নিয়ে পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে ওদের যুদ্ধে পরাজিত করেছেন। অনেক পাকিস্তানি সৈন্য মারা গেছে। অনেকে বন্দী হয়েছে।' শুনে আমি খুশি হয়ে বললাম, 'সত্যি ? তুমি কি করে জানলে ?' লাইলী বু মুখ টিপে হেসে বলল, 'সবাই জানে এখানে, শুধু তুই ছাড়া। তবে চুপ করে আছে। আমাদের এখানে পাকিস্তানিদের আবার শক্ত ঘাঁটি। একটু এদিক-ওদিক হলেই বিপদ। আমার চাচাতো আবার শান্তি কমিটির মেম্বার। এই নিয়ে বাবার সঙ্গে চাচার খুব ঝগড়া চলছে। বাবা বলছে এইসব ছেড়ে দিতে। চাচা বলছে, জান বাঁচাতে গেলে শান্তি কমিটির মেম্বার হতেই হবে। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে যে বিবাদ করে, সে নাকি মূর্খ। কিন্তু চাচাতো জানে না, এদিকে আমাদের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা আনাগোনা শুরু করেছে।' ১৮
'মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা।' কথাটা শুনে আমার বুক ধক করে উঠল। আমিও জানি মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা আমাদের দেশ উদ্ধার করার জন্যে প্রাণবাজি রেখে উঠেপড়ে লেগেছে। আমার নোটন ভাইয়াও রাতের বেলা কাদের সঙ্গে যেন মাঝে মাঝে কথাবার্তা বলে। আচ্ছা, আমাদের বাড়িতে যে দু'জন পার্টির উপরে বসে আছে, তারা মুক্তিযোদ্ধা হবে কি না ? কথাটা ভাবতেই বুকটা ধক করে উঠল। আমি জিগ্যেস করলাম, 'লাইলী বু, মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে কেমন হয় ?’ লাইলী বু আমার কথা শুনে তো হেসেই অস্থির। বলল, ‘কেমন আবার । যার যেমন চেহারা। তবে তাদের হাতে থাকে বন্দুক, স্টেনগান বা মেশিন গান । চালালে ঠা রা রা রা করে শব্দ হয়। মুখে দাড়ি থাকে, চুল ইয়া লম্বা । আমি হাঁ করে কথা শুনছি দেখে লাইলী বু মুখ টিপে বলল, 'আবার কোন কোন মুক্তিযোদ্ধা থাকে, দেখতে খু-উ-ব সুন্দর। লম্বা চওড়া চেহারা, অনেক লেখাপড়া করা, অনেক বুদ্ধি।' বলতে বলতে লাইলী বু কাপড় কাচা বন্ধ রেখে কেমন উদাস হয়ে তালগাছের দিকে তাকিয়ে থাকল। আমার মন আকুলি-বিকুলি করে উঠল। আমি বললাম, 'লাইলী বু, আমাদের বাড়িতে নোটন ভাইয়ার সাথে'— আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মা'র রাগী গলার স্বর চেঁচিয়ে আমার কানে এসে ধাক্কা দিল, 'পায়রা হতচ্ছাড়ী, ঘাটে গিয়ে কি কুমিরের সাক্ষাৎ পেলি? কখন আমি তোকে এই যাঃ আমি তো ছাই এদিকে ভুলেই গেছিলাম যে তাড়াতাড়ি কাজ সারতে হবে। তবে তাড়াহুড়ো করলে যা হয়, উঠার আগে ঝুড়ি থেকে আবার একটা মাছ টুপ করে পুকুরে পড়ে গেল। বাকি ক'টা নিয়ে আমি বাড়ির দিকে দৌড়। ১৯
ফিরে এসে দেখি সমস্ত বাড়ি, উঠোন, লেবুতলা, গোয়ালঘর নিস্তব্ধ। একটু আগে মায়ের গলা শুনেছিলাম, কিন্তু মা’ও রান্নাঘরে নেই। চ্লোর উপরে কি যেন একটা চাপানো হয়েছে, বন্ধ ঢাকনির ভেতর থেকে সি সি করে একটা শব্দ হচ্ছে। আমি মাছের ঝুড়ি রান্নাঘরে রেখে সামনে তাকিয়ে দেখি নোটন ভাইয়াদের যে ঘরটাতে মাদুর বিছিয়ে দিয়েছিলাম, সেই ঘরের দরজা বাইরে থেকে শিকল তোলা। আমি পায়ে পায়ে আমাদের ঘরের দিকে গিয়ে দেখি ঘরের দরজা ভেজানো। ঠেলে ভেতরে উঁকি মারতেই মা চমকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল । আমি দেখলাম মা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে টিনের কৌটো উপুড় করে তার ভেতর থেকে টাকা, আধুলি, সিকি আপন মনে গুনে তুলছে। মা যখন খুব মন দিয়ে কাজ করে তখন সে জিব বের করে উপরের ঠোঁট ২০
চেপে ধরে। আমাকে দরজা ঠেলে ঘরে উঁকি মারতে দেখে, চমকে গিয়ে চোখ গরম করে বলল, ‘সাড়া না দিয়ে এভাবে ঘরে ঢোকে কেউ ? দেখছিস নে আমি কাজ করছি ?' আমি বললাম, ‘বারে, আমি ফিরে দেখি তুমি রান্নাঘরে নেই। আবার নোটন ভাইয়ার ঘরের দরোজায় শিকল তোলা। মাছ ধুয়ে এনেছি।' মা শুনে নরম হয়ে বলল, ‘আমি ইচ্ছে করে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়েছি যাতে কেউ বুঝতে না পারে। তুই যা, ভাজি নামিয়ে চুলোয় কড়াই বসাগে, আমি আসছি। ঘাটে কারো সাথে দেখা হয় নি তো ?” আমি বললাম, ‘না, কারো সাথে দেখা হয় নি, শুধু লালী বু কাপড় কাচতে এসেছিল।' ‘অ, কি বলল লাইলী ?” ‘বলল, ওর চাচা শান্তি কমিটির মেম্বার বলে ওরা তাকে খুব ঘেন্না করে । আচ্ছা মা, শান্তি কমিটির লোকেরা ইসকুলের বেঞ্চি তুলে নিয়ে গেল কেন ?” মা টাকা-পয়সা গুনে আবার কৌটোয় ভরতে ভরতে বলল 'কি জানি । হয়ত ওদের মিটিং-এর জন্যে। তুই আবার লালীকে বলে আসিস নি তো যে আমাদের বাড়িতে দু'জন মেহমান এসেছে ?' ‘না, বলি নি। তবে লালী বু খুব ভাল মা। সে অনেক কথা জানে। অনেক বই পড়ে। ছুটিপুর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে পাকসেনারা, তুমি জান ? এত পয়সা কি হবে মা ?” ‘দরকার আছে, তুই যা তো এখন।’ আমি মন খারাপ করে রান্নাঘরে চলে এলাম। এদিকে আবার ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমেছে। কড়াই ধুয়ে চুলোর উপর বসাবো, দেখি মা এসে হাজির। আমাকে সরিয়ে কড়াই-এ তেল দিয়ে কইমাছ ভাঁজতে ভাঁজতে বলল, 'লক্ষ্মী সোনা পায়রা আমার, আমাদের ঘরের মেঝেয় পাটি বিছিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা ২১
করগে তো মা, দু' জনের। ফুল তোলা কাচের থালা দুটো বের করে নাওগে তাকের উপর থেকে।” এই হয়েছে আমার এক জ্বালা। মা মিষ্টি করে কথা বললে আমি না করতে পারি নে। আমি ঘরে এসে মাদুর বিছাতে না বিছোতে ঝোটন ভাইয়া বৃষ্টিতে ভিজে কোত্থেকে এসে মা'কে বলল,‘মা তাড়াতাড়ি, খুব তাড়াতাড়ি।’ আগুনের তাপে মা'র মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। মা ঢেঁড়স ভাজি, ডাল, আলু ভাজা আর কইমাছের তরকারি কাঁসার বাসনে বেড়ে দিয়ে ঢাকনি চাপিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল, ‘তাড়াতাড়ি ও ঘরে সব দিয়ে আয় তো মা। আমি ভাত নিয়ে আসছি।' আমি তরকারি নিয়ে ঘরে গিয়ে দেখি, ওমা, ছেলে দুটো এর মধ্যেই হাতমুখ ধুয়ে পাটিতে বসে পড়েছে খাবার জন্যে। একবার সাধবার সময় দেবারও তর সয় নি ! কি কাণ্ড । লম্বা ছেলেটা আমাকে দেখে হেসে হেসে বলল, ‘তোমার নাম কি, বোনটি?” আমি বললাম, ‘পায়রা ।’ ‘হা, হা, হা, হা,' মোটা ছেলেটা আমার নাম শুনেতো হেসেই অস্থির। তার দেখাদেখি লম্বা ছেলেটাও। আমি তাদের হাসি দেখে রেগে গিয়ে বললাম, ‘হাসছ যে ?' মোটা ছেলেটা বাঁশ-চেরা গলায় বলল, ‘নোটন-ঝোটন পায়রা। বাঃ এ যে পায়রার রাজ্যে এসে পড়লাম রে মন্টু। এখন বাক্ বাকুম করে ডাক তো বোনটি, শুনি ?” আমি শুনে রাগ করে বললাম, ‘মোটেই না, আমার একটা ভাল নাম ও আছে।' মোটা ছেলেটা বলল, ‘তাই নাকি, কি নাম ? ‘সাবিনা খাতুন।’ ২২
মোটা ছেলেটা তাই শুনে বলল, ‘বাঃ বেশ নাম, আর আমার নাম তুমি শুনবে ?” “কি নাম ?” ‘লাড্ডু, আমার নাম লাড্ডু। তবে দিল্লীর না, যশোরের। হা, হা, হা।' ওমা, এ ছেলেটার দেখি হাসাই হচ্ছে অসুখ। তবু লাড্ডু নাম শুনলে কার না হাসি আসবে, বলো ? আমি তাই হাসতে লাগলাম। আমার সঙ্গে সঙ্গে সবাই হেসে উঠল । মা বড় গামলার মধ্যে লাল মোটা চালের ধোঁয়া বেরোনো ভাত নিয়ে এল এই সময় ৷ ভাত দেখা মাত্তর ছেলে দুটো চুপ করে গেল। মা ওদের পাতে ভাত বেড়ে দিতে না দিতে ওরা হুসহাস করে ভাত খেতে শুরু করল। খুব গরম ভাত, কিন্তু ওরা এমনভাবে খেতে লাগল যেন একেবারে গরম না, এমন তাড়াহুড়ো ওদের ভাব। ওদের খাওয়া শেষ হতে মা তার ছোট টিনের বাক্সটা বের করে সামনে রেখে বলল, ‘এইটে নিয়ে যাও বাবারা, ক্ষেতের পেঁপে আর পেয়ারা বেচে জমিয়েছি। আরো কিছুদিন পরে এসে ডিম বেচার পয়সাগুলো নিয়ে যেও।' লম্বা ছেলেটা মায়ের দেওয়া টিনের কৌটোটা মাথায় ঠেকিয়ে ভক্তি করে বলল, ‘সালাম মা। আপনি এত কষ্ট করে পয়সা জমিয়েছেন, আর তা তুলে দিলেন আমাদের মত ঘরছাড়াদের হাতে। আমাদের কমান্ডার কামাল ভাইকে বলব।' কমান্ডার ! আমার কানে খট্ করে শব্দটা বাজল। লম্বা ছেলেটার চোখে আমার চমকে ওঠা চোখ এড়াল না। সে লাড্ডু বলে ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে কি যেন ইশারা করল। লাড্ডু তখন নোটন ভাইয়া, ঝোটন ভাইয়ার দিকে তাকাল। তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, ২৩
‘আমাকে লাড্ডু ভাইয়া বলে ডাকবে।' শুনে আমি চুপ করে রইলাম। যাকে তাকে ভাইয়া বলা আমার অভ্যেস নেই। তাছাড়া মাও কিছু বলতে বলে নি। লাড্ডু আবার বলল, ‘পায়রা, বোনটি আমার, আমাকে লাড্ডু ভাইয়া বলে ডাকবে। আজ থেকে তুমি আমার ছোট বোন, কেমন ?' আমি হতভম্ব হয়ে লাড্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখন মন্টু কাছে এসে মুখ ঝুঁকিয়ে নরম গলায় বলল, ‘আর আমাকে বলবে মন্টু ভাইয়া। তুমি আমার ছোট বোনটি পায়রা, ঠিক আছে না ?” আমি আর কি করি। মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালাম। মন্টু ভাইয়া নাছোড়বান্দার মত বলল, ‘বলো এবার, মন্টু ভাইয়া ?” আমি বললাম, ‘মন্টু ভাইয়া, লাড্ডু ভাইয়া।’ শুনে ওরা দু'জনে খুশি হয়ে হাসতে লাগল। আমি তাকিয়ে দেখি নোটন ভাইয়া, ঝোটন ভাইয়া আর মাও ওদের সঙ্গে হাসছে। আমি তখন সময় নষ্ট না করে জিগ্যেস করলাম, “তোমরা কি মুক্তিযোদ্ধা?” ‘ স্ স্ স্,’ নোটন ভাইয়া ঠোঁটে আঙুল তুলে আমাকে চুপ করিয়ে দিল। মন্টু ভাইয়া মিষ্টি হেসে মাথা নেড়ে বলল, 'হ্যাঁ, আমরা তোমার মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা। তোমার নোটন-ঝোটনও মুক্তিযোদ্ধা। আমরা আজ সবাই মুক্তিযোদ্ধা। দেশমাতৃকার বন্ধন ঘোচাতে আমরা শহীদের রক্তে হাত ভিজিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি। তবে সেকথা বলার সময় এখনো আসে নি। তাই সাবধান । এই বলে মায়ের পায়ে হাত দিয়ে আবার সালাম করে মন্টু ভাইয়া, লাড্ডু ভাইয়া উঠে দাঁড়াল। তারপর পাঁচিলের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। নোটন ভাইয়া, ঝোটন ভাইয়াও গেল ওদের পিছন পিছন এগিয়ে দিতে। ওদিকে দাদীমা তখন একভারে বলে চলেছে, “ও বউমা, ওরা কারা ? আমার যে ভাত খাবার বেলা চলে গেল। আমার পান ছেঁচে দেবে কে। ও বউমা ?' ২৪
এরা সব মুক্তিযোদ্ধা ? ভেবে একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেলাম মনে মনে । লাইলী বু রাতের বেলা গোপনে যে স্বাধীন বাংলার রেডিও শোনে, সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা দেখতে কেমন তা কোথাও বলে না। কিন্তু আমার মনে মনে যে ছবি আছে তাতে তাদের লম্বা চুল, চোখ লাল, মুখভর্তি দাড়িগোঁফ আর কাঁধে বন্দুক। অথচ এরা কেউ সেরকম দেখতে না। আর কেমন পেট ভরে হাপুস-হুপুস করে গরম ভাত খেল, সেটাও তো একেবারেই মুক্তিযোদ্ধাদের মতন ব্যবহার না ! নাঃ এখন দেখছি নিজের গরজেই কড়ে আঙুল ঠেকিয়ে চুমকির সঙ্গে ভাব করতে হবে। কুচুটে বুদ্ধিতে চুমকি সেরা। এসব ওর মাথায় খেলে ভাল। ওদের বাড়ি গিয়ে দেখলাম চুমকিও ভাব করার জন্যে মনে মনে এক পায়ে খাড়া। কিন্তু মুখে কিছু বলছে না। দোষ অবশ্য আমারই, আমিই তো আগে বুড়ো আঙুল ছুঁইয়ে আড়ি দিয়ে ফেলেছিলাম । ভাব হবার পরে আমার কথা শুনে মনে মনে চুমকিও অবাক। কিন্তু তা সে ২৫
মুখে স্বীকার করল না। বলল, “তুই তো একেবারে বোচণ্ডী। যদি সত্যি সত্যিই মুক্তিযোদ্ধা হয়, তাহলে এসব ওদের ছদ্মবেশ। যে জামাটা পরে এসেছিল তার নিচেই কোমরের কাছে ওদের লুকোনো ছিল বন্দুক। স্টেনগান বা এল.এম.জি না, ছোট্ট পিস্তল। যাতে মাত্তর তিনটে গুলি একসঙ্গে ধরে। টেম্পোরারি জান বাঁচাবার জন্যে তাই যথেষ্ট।' আমি জিগ্যেস করলাম, 'তাহলে ওদের দাড়ি, লম্বা চুল সেসব কোথায় লুকাল ?” চুমকি দেখলাম এসবের উত্তরও জানে। বলল, ওরা মুখে পাতলা রবারের মুখোশ পরে থাকে। এত পাতলা সেই মুখোশ যে তুই দেখলে বুঝতেই পারবি নে এটা নকল। যুদ্ধ করার সময় ওরা সেই মুখোশ খুলে ফেলে বেরিয়ে আসে। ওরা গেরিলা যুদ্ধ করে তো, সেই সময় ওদের দাড়ি, স্টেনগান, এল.এম.জি., থ্রি নট্ থ্রি, গ্রেনেড সবই লাগে। গ্রেনেড কি করে ছোঁড়ে জানিস, লাইলী বু’কে জিগ্যেস করিস। স্ব গেরিলা যুদ্ধ কি, আমি তো সেটাই জানি নে। অথচ চুমকি এসব জানে । গরিলা, ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জী এসব চিনি। ঝোটন ভাইয়ার বইতে ওদের ছবিও দেখেছি। কিন্তু গেরিলা ? এ নিশ্চয় চুমকির লাইলী বু'র কাছ থেকে শেখা। একবার তাহলে লাইলী বু'র কাছে গোপনে যেতে হয়। আমি চুমকির হাত ধরে বললাম, ‘চুমকি, আমি মুক্তিবাহিনীতে যেতে চাই, মুক্তিযোদ্ধা হতে চাই, কিন্তু গেরিলা হতে চাই নে। তুইও কি চাস্ ? তাহলে চল্ আমরা একসঙ্গে'- আমার কথা শুনে চুমকি এমনভাবে আমার দিকে তাকাল যে কি বলব। যেন চিড়িয়াখানার জন্তু দেখছে। মুখ গম্ভীর করে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘তোর মতন বেয়াক্কেল এই গাঁয়ে আর একটাও পাওয়া যাবে না, বুঝলি? গেরিলা কি, তাই চিনিস নে আবার মুক্তিযোদ্ধা হতে চাস্। মেয়েরা কি করে মুক্তিযোদ্ধা হবে রে ? আমি বললাম, ‘কেন, তাহলে ওরা কি হবে ? ২৬
চুমকি বলল, “ওরা হবে মুক্তিযোদ্ধাদের বোন, মা, ফুপু, খালা, শ্বাশুড়ি, দাদী শ্বাশুড়ি, এইসব। ছেলে হয়ে জন্মালে তবে মুক্তিযোদ্ধা হতে পারতিস। ড্যাং ড্যাং করে দু'দিন বাদে যাবি শ্বশুরবাড়ি, তোকে মুক্তিযোদ্ধা করবে কে রে ? শুধু শুধু পয়সার লস্।’ শোন কথা। চুমকির ভাব দেখলে মনে হয়, ও নিজে যেন ছেলে আর আমি মেয়ে। আমার রাগ হয়ে গেল মনে। আবার বুড়ো আঙুল দেখাব কি না ভাবছি, তখন কি ভেবে চুমকি বলল, ‘আচ্ছা, তাহলে চল্। লাইলী বু কি বলে দেখি । তার কথা তো বিশ্বাস করবি। ’ আমরা দু' জনে বাড়ির পিছনের বন-জঙ্গল ডিঙিয়ে রওনা হলাম লাইলী বুম্বর বাড়ির দিকে। তখন বেলা হয়েছে অনেক। নাওয়া-খাওয়ার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। মা টের পেলে নিশ্চয় বকবে। আমাদের পুকুরপাড়ের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা সরু পায়ে চলার রাস্তা। সে রাস্তা লাইলী বু’দের বাড়ির পিছনে গিয়ে থেমেছে। লাইলী বু' দের বাড়ির পাশে আরো অন্যদের বাড়িঘর আছে। তারাও আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। তাদের অনেকে পঁচিশে মার্চের পর শহরে চলে গেছে, কেউ কেউ গেছে ঢাকায়, আবার অনেকে বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়ার ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। পঁচিশে মার্চের পরপর একবার আমাদের গ্রামের ওপর পাকিস্তানিরা হামলা করেছিল। তখন অনেক লোক মারা গেছে, অনেক বাড়িঘর পুড়েছে। আমাদেরও ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়েছিল। গঞ্জে বাবার যে দোকান আছে, সেটা পুড়ে গিয়েছিল। এখন আবার বাবা সেটা ঠিকটাক করে নিয়ে চালাচ্ছে। শান্তি কমিটির লোকেরাই বলছে, একবার যে গ্রামে হামলা হয়ে গেছে, সে গ্রামে আর পাকিস্তানি মিলিটারিরা আসবে না। আমি অবশ্য কখনো মিলিটারিদের চোখে দেখি নি। আমরা কেউ চোখে দেখি নি। আমি, মা, বাবা, দাদীমা, ভাইয়ারা সবাই তখন যশোরে খালার বাসায় ছিলাম। যশোরে আমাদের নিজেদের বাড়িও একটা আছে। আমার নানার করে যাওয়া বাড়ি। মা'কে মা'র বিয়ের সময় নানা উপহার দিয়েছিল। ২৭
কিন্তু সে বাড়ি এখন যশোরের বিহারীদের দখলে। আমরা গিয়ে দেখি লাইলী বু গোসল সেরে, ভাত-টাত খেয়ে, কি একটা বই হাতে নিয়ে জানালার ধারে বসে চুল শুকোচ্ছে । আমাদের দেখে চট্ করে বইটা লুকিয়ে ফেলল। কিন্তু ততক্ষণে আমি বইটার নাম পড়ে ফেলেছি। ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালী।' কোন্ বাঙালি ? কোন্ স্বাধীনতা ? আমি মনে মনে ভেবেও কূলকিনারা বের করতে পারলাম না। আর আমাদের দেখে বইটা সে লুকোচ্ছেই বা কেন ? আমি জিগ্যেস করলাম, ‘মেয়েরা মুক্তিযোদ্ধা কেন হয় না লালী বু ?’ আমার কথা শুনে লাইলী বু অবাক হয়ে বলল, ‘এ কথার মানে ?’ ‘মানে, চুমকি বলছে মেয়েরা নাকি মুক্তিযোদ্ধা হয় না। ওরা মুক্তিযোদ্ধাদের মা, নানী এইসব নাকি হয়। সত্যি কি তাই লালী বু ?’ লাইলী বু আমার কথা শুনে এবার হাসল। তারপর উত্তর না দিয়ে উঠে গিয়ে আমাদের জন্যে নারকেলের নাড়ু নিয়ে এল একটা কাঠের বাটির মধ্যে। গোল গোল নারকেলের নাড়ু। গুড় দিয়ে মাখানো। ভেতর থেকে কর্পূরের গন্ধ এসে নাকে লাগছে। বেশ খেতে। আমি আর চুমকি একটা করে নাড়ু হাতে তুলে নিয়ে খেতে লাগলাম । তখন লাইলী বু বলল, 'প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নাম শুনেছিস তোরা ?’ আমরা তো জীবনেও নাম শুনি নি। হা করে চেয়ে থেকে দু' জনেই মাথা নাড়লাম । লাইলী বু বলল, ‘একজন মেয়ে। একজন বিপ্লবী মেয়ে। আমাদেরই দেশ চট্টগ্রামের মেয়ে ছিলেন প্রীতিলতা। বৃটিশ আমলে, সূর্যসেন মানে মাস্টার দা'র নেতৃত্বে ইংরেজদের আস্তানায় ঢুকে ইংরেজ মেরেছিলেন। সেটা ছিল উনিশশ' তিরিশ সাল। তিনি যদি বৃটিশের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা উদ্ধার করার জন্যে বিপ্লবী হতে পারেন, তাহলে আমরা এদেশের মেয়েরা মুক্তিযোদ্ধা হতে ২৮
পারব না ? আলবৎ পারব। মুক্তিবাহিনীতে যোগ না দিলেও মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়, তা জানিস ?' তা জানতাম না। তবু মন খারাপ হয়ে গেল আমার। আমার তো বাড়ি ছেড়ে বেরোনোই নিষেধ। চুমকিরও। লাইলী বু'দের বাড়ি আমাদের চেয়ে অনেক ভাল। আমাদের বাড়ির মেয়েদের শুধু ইসকুল ছাড়া আর কোথাও যাওয়া নিষেধ। এখন তো ইসকুলও বন্ধ। বেঞ্চি-চেয়ার পর্যন্ত ইসকুল থেকে লোপাট । কবে খুলবে ঠিক নেই । এখন আমরা কি করব ? শুধু গোয়াল ঝাড়ু দিয়ে, গোরুর জাবনা কেটে, হামামদিস্তায় দাদীমার পান ছেঁচে আর পুকুরে কইমাছ ধুয়ে আমাদের দিন চলবে ? কিন্তু আমাদের যে অন্য কিছু করতেই হবে । ২৯
নিজেদের অপকর্মের মাশুল গুণতে হবে এবং কেয়ামতের ময়দানে জবাবদিহি করতে হবে । আল্লাহ তায়ালা আমাদের তৌফিক দিন- (১) মানবতার নজির সৃষ্টি করতে । (২) সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি সৃষ্টি করতে । (৩) নওমুসলিমদের জন্য গ্রহণযোগ্য অবদান রাখতে । (৪) উদারতা, ন্যায়পরায়ণতা, সৃজনশীলতা, পরিপূর্ণ পবিত্রতা আয়ত্ত করতে । আল্লাহ আমাদের সহায় হোন । আমিন ১৯
আত্মীয়তার বন্ধন আত্মীয়তার প্রত্যয়টি মানব সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । আত্মীয়তার বন্ধন অটুট থাকলে একটা সুস্থ সামাজিক পরিবেশে মানুষ বসবাস করতে সক্ষম হয় । অন্যথায় সমাজে মস্তিষ্ক বিকৃতির মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে । একশত কোটি মানুষের দেশ ভারতে ষাট লক্ষ মানসিক রোগী । আমাদের বাংলাদেশ ভারতের প্রতিবেশী দেশ । সুতরাং আমাদের অবস্থা ভারতের চাইতে খুব একটা ভাল হওয়ার কথা নয় । কেন আত্মীয়তার বন্ধন অটুট থাকা জরুরী? সামাজিক মানুষ নিম্নলিখিত নিত্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর অভাব অনুভব করে । যেমন- (১) খাদ্য (২) বস্ত্ৰ (৩) আশ্রয় (৪) স্বাস্থ্য (৫) শিক্ষা । সব সময়ই ব্যক্তি মানুষ তথা পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটি আর্থিক স্বচ্ছলতার নাগাল পান না। এর ফলে সে পরিবারটি উল্লিখিত পাঁচটি অত্যাবশকীয় বিষয়ের একাধিক বিষয়ে অক্ষম হয়ে পড়তে পারেন । যাতে আত্মীয়স্বজন এই আপৎকালীন সময়ে তাদের উদারহস্ত বাড়িয়ে দিতে পারেন তার জন্যই আত্মীয়তার বন্ধন অটুট হওয়া বাঞ্ছনীয়। যখন আত্মীয়স্বজন স্বচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও আত্মীয়স্বজনের অভাব, অনটনে এগিয়ে না আসেন সে ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলো হতে পারে । যেমন- (১) অর্থের অভাবে একটি মেধাবী ছাত্র অকালে ঝরে যেতে পারে, যা দেশ ও জাতির জন্য ক্ষতিকারক । (২) অর্থের অভাবে যথাসময়ে একটি মেয়ের বিবাহ না হওয়ার কারণে পরে আর বিবাহ নাও হতে পারে যা একটি সামাজিক সমস্যা । (৩) পরিবারের কর্তাব্যক্তি অতিরিক্ত অভাবগ্রস্ত হওয়ার কারণে নিজ জীবনের উপর, নিজ পরিবারের উপর এমনকি নিজ দেশের উপর মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে নিতে পারেন । সে কারণে ধনী আত্মীয়স্বজন আল্লাহতায়ালার কাছে গুনাহগার হয়ে যেতে পারেন । উপরোক্ত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝা যায় কেন রসুল (দঃ) বলেছেন-“রক্তের সম্পর্ক ছিন্নকারী দোযখের আগুনে জ্বলিবে” । আদি আরবীয় গোত্র শক্তি এবং চিনের ক্ল্যান বা বৃহৎ পরিবার রক্ত সম্পর্কের উপর গড়ে উঠা বৃহৎ সামাজিক সংগঠন । আমাদের বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে বলতে হয় আাদের পূর্বপুরুষগণ ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৪৭ এর মত দুর্যোগ মোকাবেলা করেছে। আমরা ১৯৭১ সনের স্বাধীনতার যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি। এসব ক্ষেত্রে অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার নিঃর হয়ে গেছে। আবার অনেক ২০
নিঃস্ব পরিবার অগাধ সম্পদের মালিক হয়ে গেছে । এই যে যেকোনভাবেই হোক তারা সম্পদের মালিক হয়েছেন এই সম্পদের প্রতি শরিয়ত মোতাবেক শুধু মুসলমান আত্মীয় স্বজনের অধিকারই বর্তায়নি, বরং আমাদের বিধর্মী প্রতিবেশীদেরও অধিকার বর্তেছে । শুধু তাই নয়, সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য জীবজন্তুও মালিকানা হস্তগত করেছে । এটা আল্লাহর আইন । এটাকে লংঘনকারী সীমা লংঘন করেছে । আর আল্লাহতায়ালা সীমা লংঘনকারীকে পছন্দ করেন না । গরিব আত্মীয়স্বজনের বিপদের সময় যেসব ধনী আত্মীয়স্বজন উদারহস্ত প্রসারিত করেছেন তারা ধন্য। আবার কেউ কেউ হীন স্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন । আসলে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন তাদেরকে কিছু বলার আছে কি অসহায় আত্মীয়স্বজনের? একেবারই না। সততা, নিষ্ঠা আর কর্মঠ ব্যক্তি ধীরে ধীরে অসহায় অবস্থা থেকে মুক্তি পায়। যারা বিপদের সময় এগিয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে দুই ধরনের মানসিকতার লোক দেখা যায় । (১) বিপদের সময় সহায়তা দানকারী বিনয়ের সঙ্গে তার দানের কথাটি এড়িয়ে যান । (২) অন্য স্বভাবের লোকগুলো বারবার খোঁচা দিয়ে ঐ দানের কথাটি জনসম্মুখে প্রচার করে বেড়ায় ৷ দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা তাদের ঐ গরিব আত্মীয় স্বজনদের এ কথা মনে করিয়ে দিতে চান যে গরিবদের উচিত তাদের বাড়িতে বাড়িতে যেয়ে ঐ কৃতজ্ঞতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। যদি দরিদ্র আত্মীয়স্বজন তাদের ডেরায় ঢুঁ মারতেও চান । তারপরও বেশ কিছু সমস্যা আছে । যেমন- (১) গরিব আত্মীয়-স্বজনের কেতাদুরস্ত হওয়ার জন্য অনর্থক বেশকিছু পয়সা খরচ করতে হবে । (২) ধনী আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে গেলে তাদের মানসম্মান রক্ষা করার জন্য কিছু উপঢৌকনও নিয়ে যেতে হবে । তা হতে পারে মিঠাই মণ্ডা, হতে পারে বৃহৎ আকারের মৎস্য অথবা দুর্মূল্যের ফল-ফলাদি । এই সে ধর্না দেওয়ার জন্য অহেতুক তার বেশকিছু পয়সা বেরিয়ে গেল তাতে ঐ গরিব পরিবারটি বেশকিছু ভোগান্তিতে পড়তে পারে । যেমন- (১) ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ হতে অপচয়ের কারণে টানাপোড়েন । (২) আবাসনের থেকে বরাদ্ধ হতে ব্যয়ের কারণে টানাপোড়েন । (৩) স্বাস্থ্যগত বরাদ্ধ হতে অর্থ অপচয়ের কারণে টানাপোড়েন । (৪) বাজার খরচের বরাদ্দ হতে অর্থ অপচয়ের কারণে টানাপোড়েন । আসলে এই যে ধনী আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে ধর্না দেওয়া তথা রক্ত সম্পর্ক রক্ষা করা এ মানসিকতার পরিবর্তন জরুরী। তখনই দরিদ্র আত্মীয় স্বজন ধনী আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করতে সক্ষম হবেন যখন তারা তাচ্ছিল্যের ২১
শিকার হবেন না । অপমানিত হবেন না। যদি গরিব আত্মীয়স্বজন ধনী আত্মীয়স্বজন বাড়িতে বৌ ছেলেমেয়ে নিয়ে বেড়াতে যেয়ে এহেন তাচ্ছিল্যের শিকার হন তখন ঐ গরিব পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটি মারাত্মক ভিষন্নতার শিকার হবেন । যেমন- (১) ঐ বিব্রতকর ব্যক্তিটি তার স্ত্রী কর্তৃক উঠতে বসতে গঞ্জনার শিকার হবেন । (২) ছেলেমেয়েদের নিকট পিতার মাথা হেট হয়ে যাবে । (৩) ছেলেমেয়েরা হীনমন্যতার ভোগবে যার কারণে তাদের মনে এক ধরনের অপরাধ প্রবণতা জেগে উঠতে পারে । যেমন- (ক) তারা যেনতেন প্রকারেন ধন আহরণের চেষ্টা করতে পারে । (খ) মেধার অতিরিক্ত ক্ষয় করার কারণে যদি তারা ধনী হয়েও যায় তখন তারাও ঐ সমস্ত ধনী আত্মীয় স্বজনের মানসিকতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে । তাই আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষায় চাই উদারতা । চাই কোরআনও হাদীস থেকে শিক্ষা লাভ । বড়বড় মনীষীদের উপদেশ বাণী এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে । আমাদের জাতীয় জীবনে পরিশীলিত শিক্ষার একান্তই প্রয়োজন তা সুস্থ্য সমাজ গড়ে তোলার জন্যই । চাই আত্মীয়তার অটুট বন্ধন যা আমাদেরকে বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে পেতে সহায়তা করবে । ২২
ঈদ ঈদ অর্থ খুশি, আনন্দ, উৎসব । মুসলানদের জন্য দুইটি ঈদ নির্দিষ্ট । এতে কোন মত পার্থক্য নেই । এই দুইটি ঈদ নিয়েই আমি আলোচনা করতে চাই । এই যে ঈদ আসছে ঈদ যাচ্ছে বা বাংলাদেশের মুসলমানগণ ঈদ করছেন তা কি বাঙ্গালী মুসলমানের মধ্যে কোন খুশীর জোয়ার বয়ে আনছে! যদি খুশীই আসবে তবে দরিদ্র আর নিরন্ন মানুষের ঘরে কান্না কেন? কেন অসহায় মানুষজনকে অবস্থাপন্ন মানুষের বাড়িতে যাকাতের কাপড় আনতে যেয়ে জীবন দিতে হয়? প্রথমেই রোজার ঈদে বা রমজানের ঈদের কথায় আসতে হয়। রোজা অর্থ কৃচ্ছসাধন । কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখতে পাই? (১) সকল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায় । (২) অবস্থাপন্ন লোকেরা প্রয়োজনের তুলনায় অধিক খাদ্যদ্রব্য স্টক করে ফেলেন । (৩) অবস্থাপন্ন লোকদের দেখাদেখি গরিব মানুষেরাও পোশাক পরিচ্ছেদ ক্রয় করতে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। যার কারণ রমজানের শেষে পরিবারে অভাব অভিযোগ দেখা দেয় । (৪) একটা অপসংস্কৃতি দিনকে দিন বাঙ্গালী মুসলানদের সংসারকে উজার করছে। (৫) মুসলমান মুসলমানের ভাই এটা সমাজে পরিলক্ষিত হচ্ছে না । (৬) অবস্থাপন্ন মুসলমানের বাড়িতে যেন গরিব মুসলমান কর্জে হাসানা চাইতে না পারে তার জন্য লক্ষ টাকা খরচ করে কুকুর পোষে অথবা একজন দারোয়ান রাখে যাতে কোন গরিব আত্মীয়স্বজন ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে । বাঙ্গালী মুসলমানের মনে একটা দৃঢ় বিশ্বাস নিগড় গেড়ে আছে যে এইমাসে যতই খাওয়া যাক না কেন তার কোন হিসাব দিতে হবে না । তাই প্রতিযোগিতা চলে তেল, লবণ, চিনি, ঘি, খোরমা, খেজুর, গোস্ত, মুরগী, পিয়াজ, রসুন, আদা সংগ্রহের । এটা কেমন বিশ্বাস যে তারা একবারও ভাবে না এই যে তারা বাজার থেকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যাদি তুলে নিয়ে যাচ্ছেন তাতে অল্প আয়ের মানুষের ক্লেশ হচ্ছে । একদিকে গরিব মানুষের আহার কমে যাচ্ছে, অন্য দিকে ধনিক শ্রেণী অধিক হারে খাদ্য গ্রহণ করছে । এই যে মুসলমানগণ যারা কৃচ্ছতা সাধনের পরিবর্তে অধিক আহার করছেন এটা কি ধরনের মানসিকতা! হিসাবটাতো এমন ছিল না যে একটা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা যাতে কুসংস্কার বৃদ্ধি পাবে । বরং ভিন্নটাই হওয়ার কথা । যেমন- ২৩
(১) গরিব রোজাদারদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে যে সন্তুষ্টি আসবে তা মুসলমানের মধ্যে ঈদের আমেজ দৃষ্টি করবে । (২) নিজেরা ঈদের জন্য নতুন কাপড় না কিনে গরিব মুসলমানদেরকে পোশাক বিলানো যাতে মনে সন্তুষ্টি এসে ঈদের আমেজ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ আনন্দাশ্রু মুসলমানকে পরিশুদ্ধ করে ঈদ এনে দেবে । (৩) গরিব মানুষের সন্তানরা লেখাপড়ার খরচ জোগাতে পারে না। ধনী. মুসলমানগণ গরিব আত্মীয়স্বজনকে একটা থোক বরাদ্দ দিয়ে তাদের শিক্ষার বিষয়টি এগিয়ে নিতে পারেন । (৪) অনেক গরিব মুসলমানের ঘরের চাল চুইয়ে বৃষ্টির পানি পড়ে, এতে আসবাবপত্র নষ্ট হয় । রমজানে ধনীরা গরিব আত্মীয়স্বজনের ঘর নির্মাণ করে আল্লাহর দেওয়া ঈদকে বরণ করতে পারেন । (৫) অনেক অসুস্থ মুসলমান যারা অর্থের অভাবে চিকিৎসা করতে পারেন না তাদের চিকিৎসা খরচ মিটিয়ে আল্লাহর দেওয়া দায়িত্ব পালন করে ঈদের আনন্দ পেতে পারেন । লোক দেখানো এবাদত করা আল্লাহর সঙ্গে দুশমনি করা একই কথা । কিছু শাড়ী, লুঙ্গী দিয়ে এলাকায় আলোচনায় আসা যে আমি একজন দানবীর এটা নিছক অহংকার ছাড়া আর কিছু হয় না । কারণ অহংকার মানুষকে মানায় না। এটা আল্লাহর সিফাত । ইসলামকে বুঝতে হবে, জানতে হবে। এটা একটা জীবন ব্যবস্থা যেমন গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি তার চাইতেও ভিন্নতর । যেখানে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় সেখানে অন্য কোন তন্ত্রের দরকার হয় না । গণতন্ত্রের দরকার এই জন্য যে মানুষ স্বেচ্ছাচারী হয়ে যায় । কি মুসলমান, কি হিন্দু, কি খ্রীষ্টান, কি বৌদ্ধ । অপসংস্কৃতি ঈদের দিন গরিব পিতার জন্য দুঃখ বয়ে আনে । সন্তানরা ধনীদের অনুকরণ করতে যেয়ে পিতামাতাকে নিঃস্ব করে দেয়। কোরআন ও হাদিসে গরিব পিতামাতাকে কষ্ট দেওয়ার কোন বিধান নেই। যদি ধনিক শ্রেণীকে অনুসরণ করতে গরিব অভ্যস্ত হয়ে উঠে তাতে করে সমাজে ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনবে । আমাদের পরিশীলিত সংস্কৃতি নির্ভর সভ্যতা তেমন এগোয়নি। কিন্তু পাশ্চাত্যের দয়ায় টেকনোলজি এবং বিনোদন অনেক বেড়ে গেছে। ফলে সমাজে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। যেমন- (১) বঞ্চিত যুবক শ্রেণীর মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে । (২) ধনী শ্রেণীর মেয়েদের জীবনের নিরাপত্তা থাকবে না । (৩) ধনী শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা অপহরণ ও হত্যার শিকার হাতে পারে । (৪) চুরি ডাকাতি বৃদ্ধি পাবে । ২৪
(৫) ব্যবসায়ীদের জান ও মাল হুমকির সম্মুখীন হবে । ঈদের দিন সকল মুসলমানের হাসার কথা। কিন্তু গরিব মুসলমানের চেহারার হাসি ফুটে না । অপারগ হয়ে চেহারায় একটা হাসি হাসি ভাব অতিকষ্টে ফুটিয়ে তোলেন । ধনাঢ্য ব্যক্তিদের চাকচিক্য আর অহংকার গরিবের সমস্ত আনন্দকে মাটি করে দেয়। এই চাকচিক্য আর অহংকারের জন্য আল্লাহ তায়ালা রসুলে মকবুল আহাম্মদ মোস্তফা মোহাম্মদ মোস্তফা (দঃ) কে একটা অনুশাসন নিয়ে জগতে পাঠাননি । ইসলাম ভোগের জন্য নয় ত্যাগের জন্য । কিন্তু সমাজে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? কেবল ভোগ আর ভোগ, কোরআনের আয়াত-ওয়াতাসিমু বি হাবলিল্লাহি জামিয়া ওয়ালা তাফাররাক”-এ আয়াতের বিশেষত্বকে ভণ্ডুল করে দিচ্ছে ভোগবাদী মুসলমান। উচ্চবিত্তের অপসংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে মধ্যবিত্ত। আর মধ্যবিত্তকে দেখে জ্বলে মরছে নিম্নবিত্তরা। এর ফল কখনো ভাল হতে পারে না। এই যে মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম বিরোধী “এটিচুড এ- বিহেভিয়ার” এটা এক মহাবিভীষিকাকে আহবান করছে । এ মুসলমান সমাজকে কিছুতেই সুস্থ বলা যায় না । ফলে প্রকৃতি প্রতিশোধপরায়ণ হচ্ছে । মুসলমান শারীরিকভাবে অসুস্থ হচ্ছে। তাকে ডায়াবেটিকস্ হার্ট ডিজিস, জণ্ডিস, লিভার, ক্যান্সার, ফুসফুসজনিত রোগ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। অপরদিকে সুনামী, ঝড়- ঝঞ্ঝা, দুর্ভিক্ষ মুসলমানকে এক অবশ্যম্ভাবী কেয়ামতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে । কোরবাণীর ঈদের কথা আর নাই লিখলাম । একে তো কোরবাণীর জীব কিনতে হয়, নইলে স্ত্রী সস্তানদের গঞ্জনা শুনতে হয় । আবার গোদের উপর বিষফোঁড়া পোশাক পরিচ্ছেদ কিনাকাটাতো আছেই। আসলে মুসলমানের সংজ্ঞা কি? এটা আমাদের দেশের গরিব মানুষ অভাবের তাড়নায় বুঝতে অক্ষম । এদেশে নামাজ রোজার ওয়াজ আছে কিন্তু কিভাবে খেয়ে পরে বাঁচবে, আত্মরক্ষা করবে তাহার ওয়াজ নছিয়ত নেই । হয়তো বা আছে কিন্তু তা গরিব মুসলমানের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না। নিরন্তর কষ্ট সয়ে তাদের বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে গেছে। আর কান হয়ে গেছে বধির । তাই ধনীদের কোরবাণী করা গোস্তের জন্য তারা লালায়িত । তারা যদি বুঝত যে ধনীদের দায়িত্ব হলো গরিবদের দোরগোড়ায় কোরবাণীর গোস্ত পৌঁছানো তবে এমনটা হতো না । এখানেও প্রতিযোগিতা কে কত গোস্ত সংগ্রহ করতে পারবে। আল্লাহর রাসুল (দঃ) এর একটি বাণী- “হায়া ওয়াল ঈমান ওসমান ইবনে আফফাম” । এ হাদিসটি থেকে গরিব ও ধনী মুসলমানগণ নছিহত গ্রহণ করতে পারেন । মুসলানের মনে লজ্জা থাকতে হবে । দামেস্কের সেই মুচির কথা মনে করুন । যিনি ত্রিশ বছর ধরে সামান্য অর্থ জমিয়ে হজ্বে যেতে চেয়েছিলেন । কিন্তু পাশের বাড়ির লোক অসহায় জেনে সমস্ত টাকাটাই তাদের দান করেছেন । আর দেখুন সে বছর মুচির উছিলায় সবার হজ্ব কবুল হয়েছিল । তিনদিনের অনাহারী হয়েও যে মুসলমান আল্লাহর উপর ধৈর্য্য ধরেছিলেন । আর দেখুন মুচি বললেন আমার হজ্বের দরকার নেই । হজ্বতো কাবা সেটাতো দালানই । মানুষের ২৫
মনের চাইতে বড় কাবা হতে পারে না। কারণ কোরআনুল করিমে আল্লাহ পাক বলেছেন- আমি মানুষের নফসের মধ্যে বসবাস করি। সুতরাং আল্লাহকে বেজার করে কাবা দর্শনের অর্থ কি? প্রতিটি মুসলমানের মধ্যে মা আয়েশার খাসালত থাকতে হবে । বিপদ মুহূর্তে তিনি আল্লাহর উপর ধৈর্য্য ধরেছিলেন। আর আল্লাহতায়ালা আয়াত নাজিল করলেন- ফা সাবরুন জামিলুন । আল্লাহু মাসতাআনু ওয়ালা মা তায়্সিফুন” যে সব মুসলমান ঈদ করতে পারলো না অথচ ঈমানের উপর অটল রইল- তারা আল্লাহর সঙ্গে জান্নাতে ঈদ করবেন । আল্লাহ ঈমানদার বান্দাদের ছেড়ে যাবেন না। এটা আল্লাহর ওয়াদা । গ্রেফতার হবে তো তারা যারা ঈমানকে অবজ্ঞা করেছেন । ২৬
ক্ষুদ্রঋণ ক্ষুদ্র ঋণের সংজ্ঞা কি? তা বড় কথা নয়, আসলে ক্ষুদ্র ঋণ অর্থে সামাজিক উন্নয়নে কতটা অবদান রাখছে সেটাই হলো বড় কথা। ক্ষুদ্র ঋণ যে সকল প্রতিষ্ঠান প্রদান করছেন । মিডিয়ার পরিসংখ্যান অনুযায়ী জানা যায় যে, তারা কিন্তু লাভবানই হচ্ছেন । আরো উল্লেখ করতে হয় । দাতাগোষ্ঠী কিন্তু তাদের উপর বেজায় সন্তুষ্ট। সে অনুপাতে আমাদের সামাজিক চিত্রে কিন্তু আশার আলো নেই। গরিব আরো গরিব হচ্ছে, ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এটা শুধু আমাদের বেলায় নয় । দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারত এ ব্যাপারে এগিয়ে আছে। বস্তি সমস্য সরকারগুলোকে নাকাল করে ছাড়ছে । এই যে ক্ষুদ্রঋণ নিয়েও গরিব মানুষ লাভবান হচ্ছে না এ ব্যাপারে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কি দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন ? সেই ১৯৪৭ সনে দেশ বিভাগের পর থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং বর্তমান বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে এবং বিদায়ও হয়েছে । মাঝে মাঝে সামরিক সরকারও ক্ষমতায় এসেছে। পলিটিক্যাল সাইন্স কিন্তু বলে গণতান্ত্রিক সরকারের ভুলের কারণেই সামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে। এর পিছনে রয়েছে গণতান্ত্রিক চিন্তা ও চেতনার চর্চার অভাব । জনগণের মধ্যে গণতন্ত্র বিষয়ে কোন প্রশিক্ষণ নেই । জনগণ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় না এসে স্বাধীনভাবে সরকারের সমালোচনা করতেও ভয় পায় । কিন্তু বৃটিশ রাজতন্ত্রের অধীনে বাস করেও জনগণ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করছে । তাদের উপর কোন নির্যাতন নেমে আসে নি । আমাদের দেশে কোন পরিবর্তন আনতে রক্ত দিতে হয়। নূর হোসেনরা এর প্রকৃত উদারহণ । একই অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাপারেও । নিরীহ কৃষক, শ্রমিক যারা ক্ষুদ্র ঋণ নেয় তারা জানেও না যে তাদের ঘাড়ের উপর একটা খাঁড়া ঝুলছে । গণতন্ত্রচর্চার বড় অন্তরায় হচ্ছে সহনশীলতার অভাব । আর এই সহনশীলতা সৃষ্টিতে কোন কর্মশালা নেই । একই অবস্থা বিরাজ করছে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণের ব্যাপারেও । একটা অন্ধকার পরিবেশে উপায়ন্তর না পেয়ে এই গরিব মানুষগুলো ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করে । যারা এই ক্ষুদ্রঋণ নিচ্ছেন তাদের মধ্যে আছেন কৃষক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নিম্ন চাকুরে । এদের মধ্যে আবার আছেন বিধবা এবং স্বামী পরিত্যক্তা । যারা ঋণ নিচ্ছেন তাদের ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে আয় বাড়ানোর কোন প্রশিক্ষণ নেই । যা মাঝে মাঝে টেলিভিশনে ও খবরের কাগজে আসে সে সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র । এটা বলা নিছক অন্যায় হবে না যে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ দিয়েই খালাশ । ঋণ উদ্ধারের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কিন্তু যথেষ্ট প্রশিক্ষণ আছে । ২৭
কেন আসলে ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতারা এদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন সফল হচ্ছেন না এর কতগুলো কারণ আছে । যেমন- (১) তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় । (২) অনেকেই ঋণের টাকা আন প্রডাক্টটিভ খাতে ব্যয় করে ফেলেন । (৩) ভিন্ন খাতে ঋণের অর্থ ব্যয়ের পর তা উদ্ধারের কোন বিকল্প খাত তাদের অনেকেরই থাকে না । (৪) এদের মধ্যে কারো কারো জুয়া খেলা, নেশায় অভ্যস্ত, বিলাসিতা ও ফালতু পথে ব্যায়ের প্রবণতাও আছে । (৫) শারীরিক অসুস্থতা যা বাংলার ঘরে ঘরে মৌসুম বদলালেই হাজির হয় । তারাতো আর গরিব বড় লোক বাছবিচার করে আসে না । (৬) সংসারের কর্মঠ ব্যক্তির জীবনে হঠাৎ দুর্ঘটনা । (৭) সংসারের কর্মঠ ব্যক্তির মৃত্যু । (৮) প্রক্ষিণের অভাব । ক্ষুদ্র ঋণ কেমন গ্রহীতাকে দেওয়া উচিৎ তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি- তার নাম বাদল । (১) সে কৃষি কাজ জানে । (২) সে মাটি কাটতে ও মুটে বইতে জানে । (৩) তার আছে রাজমিস্ত্রি-এর কাজের অভিজ্ঞতা । (৪) তার আছে কাঠমিস্ত্রি-এর কাজের অভিজ্ঞতা । (৫) সে বাগান পরিচর্যা করতে জানে । (৬) সে অর্ধবেলা অন্যের জমিতে কাজ করে । (৭) সে জমি বন্ধক রেখে বাকি অর্ধ বেলা নিজ জমিতে কাজ করে । (৮) সে অন্যের জমি বন্ধক রাখে বা বর্গা চাষ করে । (৯) ঘুম ছাড়া সে অবসর সময় কাটায় না । (১০) সে শারীরিকভাবে সুস্থ্য । এই যে উত্তরণ এটা কিন্তু সকল ঋণগ্রহীতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । অথবা অনেকে সচেতনই নয় । বাদল কর্মঠ, বিশ্বস্ত এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের নিকট একজন আদর্শ কৃষক, আদর্শ শ্রমিক। শিল্প ও সংস্কৃতির জন্য “কোয়ালিটি” প্রয়োজন । কিন্তু ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য “কোয়ালিটির” প্রয়োজন নেই । ঋণ উদ্ধারের অনেক আইন আছে । আছে জেল, আছে জরিমানা । আবার আমরা বলতে পারি “কোয়ালিটি” ছাড়া “কোয়ানটিটির” বিশেষ কোন মূল্য নেই । কোয়ালিটির ২৮
জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত প্রশিক্ষণ । ন্যূনতম শিক্ষা এবং একটি অথরিটি । এই অথরিটি হতে পারে আঞ্চলিক সরকার। এর জন্য চাই সহমর্মিতা, দেশাত্ববোধ এবং সর্বোপরি মানুষ মানুষের জন্য চিন্তা ধারণাটি । আঞ্চলিক সরকার সর্বদা ঋণদাতা ঋণগ্রহীতাও আঞ্চলিক সরকারের মধ্যে সংযোগ ছাড়া দেউলিয়াপনা থেকে বাচার আর কোন বিকল্প নেই এখানে। দরকার মাসিক কর্মশালার । ঋণগ্রহীতারা কিভাবে তাদের ঋণের টাকা সঠিকভাবে বিনিয়োগ করবে, চালান হিসাবে ব্যবহার করবে এবং কিভাবে তারা লাভবান হয়ে ঋণ প্রদানকারী সংস্থাকেও সুনামের অধিকারী করবে এটা তাদের মন ও মানসে প্রোথিত করে দিতে হবে । তবেই সকল পক্ষে স্বস্তি । এটা একটা অথরিটি ছাড়া সম্ভব নয় । জেল জরিমানা একটা অভাবী পরিবারের সদস্যদের পথে বসিয়ে দিতে পারে। তারা চলে আসতে পারে বস্তিগুলোতে, সেখানে ওঁত পেতে আছে “আনরুলী” গ্রুপগুলো। যারা ফাঁদ পেতে রাখে অভাবী তরুণ তরুণী ও যুবক যুবতীদের জন্য । ২৯
ফলজ উদ্ভিদ ফলজ উদ্ভিদ বিভিন্ন কারণে অন্যান্য বৃক্ষ হতে অধিক অর্থকরী । ফলজ উদ্ভিদ ফল দেয় যা আমাদের খাদ্য, ফলজ উদ্ভিদ দেয় জ্বালানী কাঠ । ফলজ উদ্ভিদ দেয় ফার্ণিচারের কাঠ । আমরা যে হারে বিদেশী ব্যাংকগুলোর কাছে ঋণী তাতে আমাদের মর্যাদা সর্বদাই ক্ষুন্ন হচ্ছে। যে কোনভাবে আমাদের বৈদেশিক ঋণ চুকিয়ে স্বাবলম্বী হওয়া জরুরী । আমাদের বসে থাকার সময় হাতে নেই । সম্মানের সঙ্গে বিশ্বদরবারে আমাদের উপস্থিত হওয়া উচিত । আমাদের হাজার হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে । কি এমন অভিশাপ রয়েছে যে আমাদের ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ধনী দেশগুলোর সামনে হাজির হতে হয়? মূলত আমাদের এলিট শ্রেণী সঠিক পরিকল্পনা নিতে অনীহা প্রকাশ করছেন । বিদেশে আমাদের শ্রমবাজার সংকীর্ণ হয়ে আসছে যারা দেশে ফিরে আসবে তারা হয়তো গ্রামে ফিরে যেতে চাইবে না । যদি বিদেশে পুনরায় যাওয়া না যায় বা সম্মানজনক পেশা না পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে দেশেই তাদের পেশা নির্ধারণ করতে হবে । ফলজ উদ্ভিদ লাগিয়ে তার একটা সুরাহা সম্ভব বলে মনে হয় । বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সরকার এর অধীনে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদের অধীন অন্ততঃ এক লক্ষ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে । এ ছাড়াও আছে রেল লাইন এর একটা খতিয়ান দেওয়া যায় । কেন্দ্ৰ থেকে বিভাগীয় অফিস পর্যন্ত হাইওয়ে যাতায়াত ব্যবস্থা বলবত আছে । যেমন : (২) বিভাগীয় অফিস থেকে জেলাগুলোতে যাতায়াত ব্যবস্থা বলবত আছে । (৩) জেলা পরিষদ থেকে উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বলবত আছে । (৪) উপজেলা পরিষদ থেকে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত যাতায়াত ব্যবস্থা বলবত আছে । (৫) প্রতিটি নৌ-বন্দরের সঙ্গে জেলা হেডকোয়াটারের হাইওয়ে দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা আছে । (৬) এছাড়া স্থল বন্দরগুলোও যোগাযোগ নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত (৭) সমুদ্র বন্দরগুলোর গুরুত্ব আরো বেশী । এখানেও আছে হাইওয়ে । (৮) রেল লাইনের মাধ্যমে উত্তরের সকল জেলা সংযুক্ত । দক্ষিণ পূর্বে, পূর্ব উত্তরে আছে রেল লাইন । পূর্ব দিক্ষণে খুলনা ও বেনাপোল সংযুক্ত আছে রেল লাইনের মাধ্যমে । এই রাস্তাঘাটগুলো শুধুমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থা হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে । উন্নত বিশ্বে কেবল মাত্র একটি উপায় হিসাবে কোন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় না। তা হয় মাল্টিপারপাস । এই রাস্তাঘাটগুলো নির্মাণ করতে যেয়ে দেশের একটা বিশাল পরিমাণ কৃষি জমি ব্যবহার করা হয়েছে । ফলে এই বিশাল পরিমাণ কৃষি ভূমিতে আর কৃষিকাজ ৩০
হয় না । ঐ সমস্ত জমিতে যে পরিমাণ খাদ্য শস্য উৎপন্ন হতো দেশ তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে । আমাদের গ্রামাঞ্চলে একটি প্রবাদ আছে আর তা হলো, জমির দ্রোনা বাড়ির কোনা । এ প্রবাদের উদ্দেশ্য হলো নদীমাতৃক বাংলাদেশের জমি মানেই বর্ষায় ডুবে যায় । কোন কোন অঞ্চলে জমি প্রায় ছয় মাস পানির নিচে থাকে । ফলে সেখানে কেবল বোরো ধানের চাষ হয়ে থাকে । সেক্ষেত্রে বাড়ি প্রায় ১২ (বারো) মাসই পানির উপরে থাকে । ফলে ফলজ উদ্ভিদ তো থাকেই আরো থাকে সবজী ফলনের ব্যবস্থা । তাই একটি পরিবার যেখানে কর্মঠ পুরুষ ও নারী রয়েছে তাদের খাদ্যের অভাব হয় না । বলা যায় তারা হয়তো বাবুয়ানা জীবন জাপন করতে পারে না। কিন্তু তারা সম্মান জনক ভাৱেই বেঁচে থাকতে পারেন । যদি বাড়িগুলোতে ফলের চাষ হতে পারে তবে রাস্তাগুলোতে হবে না কেন? আসলে হচ্ছে । তা ক্ষুদ্র আকারে । যারা কর্মঠ তারা নিজেদের বাড়ির সম্মুখ দিয়ে যাওয়া রাস্তায় ফলগাছ লাগাচ্ছে । আবার ঝামেলার কথাও ভাবছে । তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কৃষকরা কলাগাছ লাগাচ্ছে । আর সিএন্ডবি লাগাচ্ছে কাঠগাছ । সিএন্ডবি গাছ বিক্রি করে তা দিয়ে রাস্তার সংস্কার করে । তারা সে ক্ষেত্রে যদি ফলজ উদ্ভিদ রোপণ করে তবে তা দিয়েও সংস্কার করা যায় । তবে একটা আলাদা ব্যবস্থাপনায় ঝুঁকি তারা নিতে যাবে কেন? আমরা ভেবে দেখতে পারি এ সমস্ত জায়গায় হাইওয়ে ও রেললাইনে এক ধরনের ফলগাছ লাগাতে পারি । হাইওয়েগুলোতে আমরা- (১) আমগাছ লাগাতে পারি । যদি কলমের আম গাছ হয় তা দ্রুত ফল দেবে । একটা নির্দিষ্ট সময়ে গাছ বিক্রি করে দিলে কাঠ গাছের চাইতে বেশী মূল্যও পাওয়া যাবে । কেননা আম গাছের লাকড়িকে জ্বলনশীলতা বেশী । তাই এর চাহিদাও বেশী । তাছাড়া নদীতে ঘের দিতে আম গাছের ডাল বেশী গ্রহণযোগ্য। সম্ভবতঃ মাছ এর পচনশীল ছাল থেকে পছন্দ করে । (২) বরেন্দ্র অঞ্চল ও পাহাড়ি অঞ্চল দিয়ে নির্মিত হাইওয়েগুলোতে আমরা কাঁঠাল গাছ লাগাতে পারি । কাঁঠাল দ্রুত ফলনশীল । কাঁঠালের কোন অংশই ফেলনা নয় । কাঁঠালের উচ্ছিষ্ট অংশ গবাদী পশুর উত্তম খাবার। কাঠালের বিচি উত্তম শবজী । এমনকি এ থেকে অধিক ক্যালরিও সংগ্রহ করা সম্ভব হয় । এ ছাড়া উঁচু রাস্তাগুলোর পাশে আমলকি, কামরাঙ্গা, আমড়ার চাষ করা যায়। কাঁঠাল কাঠের চাহিদা প্রচুর । সেগুনের পরে যে কাঠটি ফার্ণিচার নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা রাখে তা হলো কাঁঠাল কাঠ । কক্ষের দরজায় কাঁঠাল কাঠ ব্যবহার ধনীদের জন্য । কাঁঠাল কাঠে কোন ঘুন পোকা আক্রমন করতে পারে না। এটা বার্নিশের পর সেগুনের মত দেখায় । কাঁঠাল কাঠের সৌন্দর্যই আলাদা । এখন আমাদের ভেবে দেখা দরকার । কি পরিমাণ ফল আমরা পেতে পারি । এক লক্ষ কিলোমিটার হাইওয়েতে অন্ততঃ পাঁচ কোটি গাছ থেকে পঞ্চাশ কোটি টন ফল উৎপাদন সম্ভব । এর মধ্যে দশ লক্ষ টন আম এবং চল্লিশ লক্ষ টন কাঁঠাল উৎপাদন ৩১
করা যেতে পারে । শুধুমাত্র প্রতি বছর ফল থেকেই অন্তত প্রতিটনে ৪০,০০০/- টাকা করে হলে ৫,০০,০০০×৪০,০০০ = ২০০,০০,০০০,০০০/- টাকা আয় করা সম্ভব। যেখানে সরকার দুই হাজার কোটি টাকার আয় করতে পারেন সেখানে প্রতি বছর পাঁচশত কোটি টাকা খরচ করতে কেন আগ্রহী হবেন না। যারা বিদেশে যেয়ে মারা যান, কষ্ট করেন, অনাহারে থাকতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না তাদের মধ্যে অনেকে তো সহজলভ্য কাজ পেতে আগ্রহী হে বেনই । তবে সরকার আগ্রহী হলে বিভিন্ন পেশার লোকদেরও এ কাজে ব্যবহার করতে পারেন । যেমন- (১) গুপ্তচর বাহিনী (কেবলমাত্র সীমান্ত এলাকার জন্য) (২) গ্রাম পুলিশ । (৩) আনসার । (৪) প্রাইমারী শিক্ষক । (৫) পরিবার পরিকল্পনা কর্মী । (৬) পল্লী ডাক্তার । আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ আছে । তাহা হলো যারে দেখতে নারি তার চলন বাকা । সমাজে ভাল কিছু কাজ করতে চাইলে বাধা আসবেই । তার কারণ হল ক্ষমতার অপব্যবহার । কিছু লোকই আছে যারা ভালোর ভালো কোন কাজ তো করতেই পারে না । উপরন্তু ভাল কাজে বাধা সৃষ্টি করে । এদের কাজ হলো দুই পক্ষের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে মজা লোটা। এরাই আবার মধ্যস্থতায় এগিয়ে আসে এবং মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাট্টা খায় । এদের সম্বন্ধে কোরআন ও হাদিসে সাবধান করা হয়েছে- তাদের গুনাহ মাফ হওয়ার কোন কারণ নেই ৷ উপরে উল্লেখিত পাঁচ, পেশার মানুষকে চোখ রাঙ্গিয়ে দেওয়া অতো সহজ ব্যাপার নয় । যখন সরকার নিজ থেকে ফলজ বৃক্ষ রোপনে অগ্রণী ভুমিকা পালন করবে তখন এই পাঁচ পেশার মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রমজীবী মানুষের হাত শক্তিশালী হবে । ফলজ উদ্ভিদ দৃষ্টিনন্দন। যখন লক্ষ লক্ষ বৃক্ষ ফুল ও ফলে সুবাসিত হতে থাকবে তখন পরিবেশই আলাদা রূপ ধারণ করবে। মধু একটি ঔষধ স্বরূপ । যারা মৌমাছি পালন করেন তারা ফলের মৌসুমে এই সমস্ত রাস্তার ধারেই বাক্স পেতে রাখবে মধু সংগ্রহের জন্য । পাঁচ কোটি বৃক্ষের ফুলের মধু একটা বিশাল পরিমাণের ব্যাপার । এমন একটা মহতি কাজের জন্য সরকারের অঙ্গ সংগঠনগুলোর এগিয়ে আসা উচিত হবে । এই খাতে লক্ষাধিক শ্রমিকের প্রয়োজন পড়বে। এর একটা সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে সমাজে । যেমন- (১) প্রায় লক্ষাধিক শ্রমিক যাদের বিদেশে গিয়ে ভাগ্যান্বষণে নিয়োজিত হওয়ার কথা এবং এ ব্যাপারে সরকারের যে পদক্ষেপ থাকার কথা তা রহিত হবে । (২) দেশের উপর যে বৈদেশিক ঋণের বোঝা তা কিছুটা হলেও দূর হবে । (৩) বিশ্বের দরবারে এটি একটি অনুকরণীয় পন্থা হিসাবে স্বীকৃতি পাবে । ৩২
(৪) ল্যান্ড ইরোশন কমবে । (৫) সমাজে বখাটেদের উৎপাত ধীরে ধীরে কমে আসবে । (৬) গ্যাস ও বিদ্যুতের উপর চাপ কমবে । (৭) সর্বদা রাস্তায় একটা প্রশিক্ষিত জনবল থাকার কারণে দুর্ঘটনার মাত্রা কমবে ৷ (৮) ধান-গম ও ভুট্টার উপর যে চাপ তা কমবে । (৯) এই বিরাট ব্যবস্থাপনা তদারকির জন্যও পরিবহনের প্রয়োজনে বেশ কিছু বেহিক্যাল দরকার পড়বে যা এম্বুলেন্সের বিকল্প হিসাবেও ব্যবহৃত হবে । (১০) দেশের চাহিদা পূরণের পর প্রক্রিয়াজাত করে বিদেশে রপ্তানি করা যাবে । এই ফল বৃক্ষের পাশাপাশি আদা, হলুদ, ঔষধিফল, ভেষজ ও সবজির চাষ করা যাবে যাতে ফলের সমপরিমাণ অর্থ আয় সম্ভব হবে । আসুন মঙ্গালীকের পথে – ৩ ৩৩
নারী নির্যাতন সুদীর্ঘকাল থেকেই নারীর উপর নির্যাতন হচ্ছে এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। ক্রীতদাস প্রথায় নারী ও পুরুষ উভয়েই পণ্য । তবে নারীর ব্যাপারটা আলাদা । কারণ, পুরুষকে নিম্নলিখিত কায়িক পরিশ্রম করতে হয় যথাঃ (১) কৃষি কাজ । (২) পাহাড়-পর্বত ধ্বসিয়ে কৃষি কাজের জমি তৈরী করা । (৩) যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিক হিসাবে যুদ্ধ করা । (৪) পশু পালন ও জংলি পশুকে বসে আনা । (৫) জাহাজ নির্মাণ ও নাবিক হিসাবে ব্যবহার ইত্যাদি । অপরদিকে নারীকে নিম্নলিখিত কাজগুলো করতে হয় যথা ঃ (১) গৃহস্থালীর কাজ । (২) অভিজাত শ্রেণীর মহিলাদের সেবাদাসী হিসাবে কাজ করা । (৩) রাত্রিতে মালিকের মনোরঞ্জন করা । (৪) পতিতা হিসাবে দেহদান করা । (৫) জিনিসপত্রের বিনিময় মূল্য হিসাবে নারীকে ব্যবহার । বাংলাদেশ প্রেক্ষিতে লিখতে গেলে বলতে হয়, এই সেইদিন ফখরুদ্দিন মোবারকশাহ এর আমলেও ইবনে বতুতা বাংলাদেশ থেকে নারী ক্রয় করেছেন । আসলে আমরা কি এখনো নারীকে পণ্য হিসাবে ব্যবহার করছি না? 'সো বিজন্সে' এর কথাটাই ধরা যাক । নারীতো পণ্যই । শুধু ধারণাটা পাল্টে গেছে । বাংলাদেশে নারীর স্বর্ণযুগ বলতে গেলে বলতে হয় বৃটিশ আমল । সম্ভবতঃ তখন নারীর ‘রেসিওটা' পুরুষের চাইতে কম ছিল । 'পোন' বা ক্রয়মূল্য তখন বৃটিশ বাংলায় বেশ পরিচিতি লাভ করে । কৃষ্ণবর্ণের নারীদের এ সমাজে কখনো কখনো 'কদবানু' নামে নাম রাখা হতো । অথচ এদেরও ক্রয় মূল্য দিয়ে বিয়ে করতে হতো। এই পোন বা ক্রয়মূল্য ছিল কৃষি জমি বা ফলজ বাগান । তারপরও একটা ব্যাপার ছিল আর তা হলো কৌলিন্য । এ ব্যাপারে হানাফিদের মধ্যে স্বয়ং ইমাম আবু হানিফা (রাঃ) থেকে কেয়াস আছে । আর তা হলো, স্বাধীন নারী এবং ক্রীতদাসীর একই মোহর হতে পারে না । তাই গবেষণায় দেখা যাবে যে কৌলিন্য অনুযায়ী এই পোন বা ক্রয়মূল্যের তারতম্য সহজেই দৃষ্টিগোচর হতো । বাংলাদেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাঁদীর সন্তান নামে একটা কুসংস্কার আছে । এক সময় হয়তো সারা বাংলাই এই কুপ্রথা ছিল । এতদঞ্চলে জমিদার ও জোতদার পরিবারগুলোতে শ্বশুর বাড়ি থেকে কনের সঙ্গে বাদী দেওয়া হতো । এ সব বাদীর পরবর্তীতে ঐ সব জমিদার ও জোতদার স্বামীরা স্ত্রী হিসাবেই ব্যবহার হতেন । ৩৪
End of preview. Expand in Data Studio
README.md exists but content is empty.
Downloads last month
26